দেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আজ ২৩শে জুন পালন করছে সংগঠনটির প্লাটিনাম জুবিলি বা ৭৫ বছর। এই দীর্ঘ সময়ের বড় অংশটিই দলটি বিরোধী দল হিসেবে সক্রিয় ছিল।এরপর টানা গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটির ‘নীতি’ এবং ‘বৈশিষ্ট্যে’ আমূল পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কেউ কেউ মনে করেন, পাকিস্তান আমল ও পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে বিরোধী দলের ভূমিকায় যেসব ইস্যুতে দলটি সোচ্চার থেকেছে, ক্ষমতায় আসার পর সেসব ইস্যুতেই ভিন্ন অবস্থান দেখা যাচ্ছে দলটির।
বিশেষ করে গণতন্ত্র, নির্বাচন, ভোটাধিকার ও মানবাধিকার ইস্যুতে দলটির যে দীর্ঘকালের অবস্থান, তার সাথে গত দেড় দশকে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলটির অবস্থানের মিল পান না অনেকেই।
যদিও দলটির নেতারা এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বলেছেন সরকারে থাকলে বিরোধী দলের ভাষায় কথা বলা যায় না, তবে দলটি তার আদর্শিক ও রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়নি বলেই দাবি করেছেন তারা।
প্রসঙ্গত, ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন ঢাকায় গঠিত হয়েছিলো নতুন একটি রাজনৈতিক দল- পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। তখন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান দলটির যুগ্ম সম্পাদক হয়েছিলেন।
দলটির আত্মপ্রকাশের ছয় বছরের মাথায় দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দেয়া হয়, যার উদ্দেশ্য ছিলো ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দলটি সত্তরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তখন পাকিস্তানের ক্ষমতায় যেতে পারেনি। বরং তখন পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার ২৫শে মার্চের রাতে সামরিক অভিযান শুরু করলে ওই নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
পরে নয় মাসের যুদ্ধের পর পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ এবং স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর সালের পনেরই অগাস্ট শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা হারায় দলটি।
বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের ছয়ই ডিসেম্বরের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের দিনটিকে ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’ হিসেবে পালন করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
গত ডিসেম্বরে দিনটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তাতে তিনি বলেছিলেন, “ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, জনগণের ভোট ও মৌলিক অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সংগ্রাম করেছে, দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে অংশগ্রহণ করেছে”।
ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের মতে জন্মলগ্ন থেকেই গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ এবং ধাপে ধাপে আন্দোলনের মাধ্যমে জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করতে পেরেছিলো দলটি।
“পুরো পাকিস্তান আমলের ২১ বছরের মধ্যে ‘৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের অংশ এবং ‘৫৭ সালে কিছু দিন প্রাদেশিক সরকার ছিলো আওয়ামী লীগের। এর বাইরে পুরো সময়টাই বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিলো আওয়ামী লীগ,” বলেছেন তিনি।
মূলত: পাকিস্তান আমলে দুই সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমেই পূর্ব পাকিস্তানের একক দল হয়ে উঠেছিলো আওয়ামী লীগ এবং ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে দলের একটি অংশ বেরিয়ে গেলে একক নেতা হিসেবে উঠে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীনতার পর প্রথম সাড়ে তিন বছর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলো দলটি। ওই দিনই ঢাকায় সেনাবাহিনীর একদল সদস্যের হাতে প্রাণ হারান শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দুই কন্যা ছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যরা।
এরপর থেকে টানা ২১ বছর বিরোধী দলে ছিলো আওয়ামী লীগ। এ সময়টিতে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন এবং পরবর্তীতে বিএনপি আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে সাফল্য পায় দলটি।
এ আন্দোলনের মুখেই ১৯৯৬ সালের মার্চে দাবি মেনে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। কিন্তু তার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানে সংযোজন করে সংবিধান সংশোধন বিল পাশ হয় সংসদে।
এরপর ৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জিতে একুশ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সাবেক সদস্য নূহ উল আলম লেনিন বলছেন বিরোধী দলে ছিলো থাকার সময় আওয়ামী লীগের ইস্যু ছিলো গণতন্ত্র, দ্রব্যমূল্য কমানো, ভোটাধিকার আদায় এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।
“কখনো বিরোধী দলে থেকেই আবার কখনো সরকারে এসে এসব দাবি বাস্তবায়ন করতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। তাই পাল্টে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে , “…জিয়াউর রহমানের লোক দেখানো ভোটের স্টাইলে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি নাটকীয় ভোট করে জোর করে ক্ষমতায় থাকার অপচেষ্টা করে বিএনপি।
কিন্তু প্রহসনের এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে রাজপথে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তীব্র গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন খালেদা জিয়া”।
সর্বশেষ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন- সেই ইস্যুতে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের এক পর্যায়ে রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হয় এবং বাতিল হয়ে যায় ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারির নির্বাচন, ক্ষমতা নেয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
সেই সরকারের অধীনে নির্বাচনে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ।
অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলছেন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার থেকে, যা এদেশের মানুষ পাকিস্তানের চব্বিশ বছরে পায়নি।
“স্বাধীনতার পর বায়াত্তরে সংবিধানের মাধ্যমে গণতন্ত্রের যাত্রাটাও ঠিক ছিলো। কিন্তু ৭৫ এ বাকশাল করা হলো।যদিও বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন এটি সাময়িক,” বলছিলেন মি. হোসেন।
প্রসঙ্গত, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে বাকশালের মাধ্যমে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগকে সবসময় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। এসময় চারটি রেখে বাকী সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়ারও অভিযোগ আছে।
১৯৯৬ সালের বারই জুনের নির্বাচনে জেতার পরের পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
কিন্তু ২০০৯ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আদালতের একটি আদেশের সূত্র ধরে এক পর্যায়ে সংবিধান থেকে সরিয়ে দেয় বিধানটি।
এরপর তিনটি নির্বাচন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে এবং এর প্রতিটিই ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়েছে।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নিলেও নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন মুক্তিযুদ্ধের পর জয়ের আবহ নিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের মধ্যে যেমন বেপরোয়া ভাব তৈরি হয়েছিলো এখনো তাই দেখা যাচ্ছে।
“অন্য দল ও মতকে আমলে না নেয়ার প্রবণতা তখনো ছিলো, এখনো আছে। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে বিরোধী দলে থাকার সময় যে অবস্থান ছিলো দলটির সরকারি দলে তার প্রতিফলন পাওয়া যায়নি।
ভোটের নামে গত তিনটি নির্বাচনে যা হয়েছে তা সবার জন্য লজ্জার,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি। যদিও আওয়ামী লীগের নেতারা গত কয়েকবছর ধরেই গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নের ওপরই বেশি জোর দিয়ে আসছেন।
সরকারের ধারাবাহিকতা থাকায় উন্নয়ন হয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। অন্যদিকে গণতন্ত্রহীনতার যে অভিযোগ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ওঠছে তাকে যৌক্তিকই মনে করেন অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
“আমার মনে হয় আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে দলটা ভালো থাকে। গণতন্ত্রের প্রতি যে অঙ্গীকার আওয়ামী লীগ করেছিলো সেটা কতটা রক্ষা করেছে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের এই আদর্শচ্যুতি পীড়া দেয়,” বলছিলেন তিনি।
অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, ক্ষমতায় এসে প্রতিটি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তার দলীয় কর্তৃত্ব স্থাপন করছে, যার ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে গেছে।
“মানবাধিকারের ক্ষেত্রে যে রেকর্ড এ সরকার তৈরি করেছে তা বিশ্বব্যাপী সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। মত প্রকাশের অধিকার সীমিত হয়েছে। আর যেনতেন নির্বাচন করে যে কোন প্রকারে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার অগণতান্ত্রিক চিন্তার ফাঁদে পড়ে গেছে আওয়ামী লীগ”।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে চলতি বছর এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ২০২৩ সালে দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন হয়নি।
এতে বলা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ওইসব ঘটনার সাথে জড়িত কর্মকর্তা বা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের শনাক্ত ও শাস্তি দিতে সরকার বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
উল্টো তাদেরকে “ব্যাপকভাবে দায়মুক্তি” দেওয়ার অসংখ্য খবর রয়েছে। যদিও সরকার এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং বাঙালি জাতির চিরায়ত শান্তি ও মর্যাদাময় জীবন নিশ্চিতের জন্য, আওয়ামী লীগ সবসময়ই গণমানুষের মানবাধিকার সুরক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
সরকারে থাকলে তাই মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করাই হয় আওয়ামী লীগের প্রথম অগ্রাধিকার”।
আপনার মতামত জানানঃ