বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করে ভারতের রেল ট্রানজিট ও তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে দুই দেশের সরকার প্রধানের বৈঠকে। শনিবার ভারতের নয়াদিল্লিতে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মোট দশটি সমঝোতা স্মারকে সই করে দুই দেশ।
বৈঠক শেষে বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা বলেছেন, বাংলাদেশের ভূখন্ডকে ব্যবহার করে ভারতের একটা অংশ থেকে ভারতেরই আরেকটা অংশে রেলওয়ে সংযোগ চালু করতে দুই নেতার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে।
ট্রানজিট চালুর পর ভারতের ট্রেন বাংলাদেশের দশর্না দিয়ে প্রবেশ করে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি সীমান্ত দিয়ে ভারত প্রবেশ করবে। পরীক্ষামূলকভাবে আগামী মাসেই বাংলাদেশ দিয়ে ভারতের রেল চলবে বলে জানিয়েছেন মি. কোয়াত্রা।
বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা শুভজ্যোতি ঘোষ জানিয়েছেন, দুই দেশের নেতাদের বৈঠকে রেল ট্রানজিটের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পায়।
তিস্তা নদীর পানির সঠিক ব্যবহারে তিস্তা প্রকল্প নিয়েও আলোচনা হয়েছে দুই সরকার প্রধানের এই বৈঠকে।
বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কারিগরি দল শীঘ্রই বাংলাদেশ সফর করবে।’’
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে অনুষ্ঠিত এই বৈঠককে ফলপ্রসূ বলে দাবি করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা রাজনীতি ও নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও যোগাযোগ, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতাসহ পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি”।
টানা তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর দেশটিকে কোনো সরকারপ্রধানের এটাই প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর।
বর্তমানে পাঁচটি রুটে বাংলাদেশ-ভারত ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে তিনটি যাত্রীবাহী ইন্টারচেঞ্জ, বাকি দুটি পণ্যবাহী। বর্তমান পদ্ধতিতে ভারতীয় ট্রেন সীমান্তে আসার পর বাংলাদেশি ইঞ্জিনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসে।
বাংলাদেশি চালক তা চালিয়ে আনেন। ফেরার সময়েও একই রকম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
কিন্তু পরীক্ষামূলক যাত্রার জন্য ভারতের সাম্প্রতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে দেশটির এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ট্রেন নিতে চায়।
বাংলাদেশেল গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ভারত এর আগে প্রস্তাব দিয়েছিল, পরীক্ষামূলক যাত্রার পণ্যশূন্য রেলগাড়ি ভারতের গেদে থেকে বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় আসবে। সেখান থেকে পাবনার ঈশ্বরদী, নাটোরের আব্দুলপুর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, নীলফামারী সীমান্তবর্তী চিলাহাটী স্টেশন হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ী স্টেশনে যাবে।
তবে দেশটির নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী ট্রেনটি হলদিবাড়ী থেকে যাবে ভুটান সীমান্তবর্তী ডালগাঁও স্টেশন পর্যন্ত।
শনিবার দুই দেশের সরকার প্রধানের বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব মি. কোয়াত্রা বলেছেন, রেলওয়ে ট্রানজিট ইস্যুটা দুই দেশের নেতার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণভাবে আলোচনা হয়েছে।
তিনি বলেন, “এই ট্রানজিট চালু হলে নিজ দেশের মধ্যে রেলপথে দূরত্ব অনেকখানি কমবে ভারতের। ভারত আগে থেকেই এটা চেয়েছিল। এটা কিভাবে বাস্তবায়ন হবে তারও একটি পরিকল্পনা এরই মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে”।
এর ফলে গেদে-দর্শনা সীমান্ত থেকে থেকে হলদিবাড়ি-চিলাহাটি রুটকে সংযুক্ত করা হবে।
দিল্লি থেকে বিবিসি সংবাদদাতা শুভজ্যোতি ঘোষ জানান, এই ট্রানজিট চালু করতে নতুন রেলপথ নির্মাণ হবে নাকি যেটি আছে সেটিকে সংস্কার করা হবে সেটি পরিস্কার করেননি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব।
তবে পররাষ্ট্র সচিব মি. কোয়াত্রা বলেছেন, এই ট্রানজিট চালু হলে এটা উভয় দেশের মানুষ ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে।
শনিবার বাংলাদেশের রাজশাহী থেকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা রুটে ট্রেন চালু করতে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারকও সই হয়।
বাংলাদেশ ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে শক্তিশালী করতে যে দশটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে তার মধ্যে সাতটিই নতুন। আর বাকি তিনটি সমঝোতা স্মারক নবায়ন করা হয়েছে।
শনিবার দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ও দুই দেশের প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের পর এসব সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসস।
দুই দেশের সরকার প্রধানের মধ্যে বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সংযোগ, জ্বালানি, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সমুদ্র সম্পদ, বাণিজ্য, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন অংশীদারত্বের বিষয় স্থান পায়।
নতুন সাতটির মধ্যে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরভিত্তিক সুনীল অর্থনীতি ও সমুদ্র সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক সই হয় দুই দেশের সরকারের মধ্যে।
সমুদ্রবিজ্ঞান এবং এ ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে আরেকটি সমঝোতা চুক্তি হয় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইন্সটিটিউট (বিওআরআই) এবং কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাসট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর) ইন্ডিয়ার মধ্যে।
টেকসই ভবিষ্যতের জন্য দুই দেশের মধ্যে ডিজিটাল ও সবুজ অংশীদারত্ব বিষয়ক নতুন দুটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছে।
যৌথ কৃত্রিম উপগ্রহ প্রকল্পের জন্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল স্পেস প্রমোশন অ্যান্ড অথরাইজেশন সেন্টার, ডিপার্টমেন্ট অব স্পেস, ভারতের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নতুন সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে।
ডিএসসিসি, ওয়েলিংটন এবং ডিএসসিএসসি, মিরপুরের মধ্যে সামরিক শিক্ষা সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য নতুন একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়।
আর নবায়ন করা তিন সমঝোতা স্মারক হল, মৎস্যসম্পদ সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক এবং স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতে সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক।
বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই বৈঠককে ফলপ্রসূ বলে দাবি করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, “ঢাকা ও দিল্লি নতুন যাত্রা শুরু করেছে, উভয় দেশ রূপকল্প ২০৪১ ও বিকশিত ভারত ২০৪৭ অনুসরণ করে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে”।
তিনি বলেন, “তারা সমঝোতা স্মারক সম্পাদন করেছেন, বেশ কয়েকটি নবায়ন করেছেন এবং ভবিষ্যতে সহযোগিতার জন্য ঘোষণা দিয়েছেন।”
বাংলাদেশের সরকার প্রধান বলেন, “বাংলাদেশ ও ভারত ‘ডিজিটাল পার্টনারশিপ’ এবং ‘টেকসই ভবিষ্যতের জন্য সবুজ অংশীদারিত্ব’ এর জন্য একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে সম্মত হয়েছে”।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ভুমিকার কথা স্মরণ করেন শেখ হাসিনা। বলেন, “ভারত আমাদের প্রধান প্রতিবেশী, বিশ্বস্ত বন্ধু এবং আঞ্চলিক অংশীদার”।
গত ৯ জুন প্রধানমন্ত্রী মোদির শপথ অনুষ্ঠানে তিনি অন্যান্য যোগ দিয়েছিলেন। সে কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি একই মাসে নজিরবিহীনভাবে দ্বিতীয়বারের জন্য নয়া দিল্লি সফর করছি।”
তিনি বলেন, “এটি আমাদের দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক প্রতিনিয়ত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।”
আপনার মতামত জানানঃ