গত দু-এক মাসে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী সংকটের কারণ ব্যাখ্যায় নানা রকম নবতত্ত্বের অবতারণা করে যাচ্ছেন। সরকারি নীতিপ্রণেতাদের ব্যর্থতা আড়ালের কৌশল হিসেবেই পশ্চিমের ওপর এই দোষারোপ—তা ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছি।
কয় দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক একলাফে ডলারের দাম ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকায় তুলে দিল। এ নিয়ে নানামুখী হইচই চলছে। এটিই ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিশ্রুত সেই ‘ক্রলিং পেগ’—এ রকম দাবি যেমন অসত্য, তেমনই উদ্ভট প্রত্যাশা যে এর পর থেকেই রিজার্ভ সংকটের সমাধান হয়ে যাবে। এটি ক্রলিং পেগ বা হামাগুড়ি গাঁটছড়া নয়। এর নাম ‘আইএমএফের চাপ খেয়ে আকস্মিক উল্লম্ফন’ বা ‘জাম্পিং পেগ’, মানে লাফিয়ে লাফিয়ে বিনিময় হারের নির্ধারণ।
ধন্যবাদ আইএমএফকে। তারা এক দিনের বৈঠকে কী যেন জাদুটোনা করল, যার ভয়ে রাতারাতি তিন বড় পরিবর্তন: ১) ডলারের দামে রেকর্ড সাত টাকার উল্লম্ফন, ২) নীতি সুদহারের বৃদ্ধি ও ৩) উদ্ভট ‘স্মার্ট’ পদ্ধতির ‘আনস্মার্ট’ বিদায়। এগুলো চলমান সংকট নিরসনে সহায়তা করবে।
চলমান সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অকপটে স্বীকার করছেন যে এমন সংকট তিনি কর্মজীবনের কোনো দিন দেখেননি। এটি যেমন সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য নীতি প্রণয়নে কখনো ঢিলেমি ও কখনো অস্থিরতা এই সংকটকে আরও দীর্ঘজীবী করেছে। জ্বালানি উপদেষ্টা তা স্বীকার না করে এই সংকটকে ‘পশ্চিমা ষড়যন্ত্র’ বলে এক নবতত্ত্বের অবতারণা করেছেন।
২০২২ সালে মূল্যস্ফীতি যখন ঊর্ধ্বমুখী এবং সব দেশে যখন নীতি সুদহার বাড়ানোর সমন্বিত অনুশীলন শুরু হলো, তখন ব্যবসায়ী ও খেলাপিদের সন্তুষ্টির জন্য শুধু বাংলাদেশ সুদটুপি ধরে রেখে মূল্যস্ফীতিকে আরও টগবগে করা হলো। বড় বড় আমদানিকারককে তুষ্ট রাখার চেষ্টায় ডলারের দাম বাড়িয়ে বাজারের সঙ্গে সমন্বিত করা হয়নি। এর শাস্তি এখনো চলছে।
একবার রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে রাতারাতি রক্তচাপ কমানো যায় না। অর্থনীতিবিদ কিনস মূল্যের নিম্নমুখী অনমনীয়তার কথা তাত্ত্বিকভাবে প্রথম উল্লেখ করেন, যাকে এখন আমরা আটকে যাওয়া দাম বা ‘স্টিকি প্রাইস’ বলে থাকি।
মাত্র কয় দিন আগে এক গ্রন্থপ্রকাশ অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন যে অতীত ভুলের খেসারত দিচ্ছে এ দেশের অর্থনীতি। কেউই জ্বালানি উপদেষ্টার মতো এই সংকটের পেছনে আমেরিকা বা পশ্চিমের কোনো কূটকৌশল আবিষ্কার করতে পারেননি।
উপদেষ্টা আরও দাবি করেছেন যে মূল্যস্ফীতি, ডলারের অভাবসহ উন্নয়নশীল দেশের আরও সংকটের পেছনে এই পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র দায়ী। বলা বাহুল্য যে মূল্যস্ফীতি বা ডলার-সংকটের বিষয়টি অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশেই এখন আর প্রকট নয়। নয় ভারতেও, এগুলো প্রবল এখানেই। আমাদেরই কর্মদোষে।
ভারতের মূল্যস্ফীতি এখন নিয়ন্ত্রিত—নেমেছে ৪ দশমিক ৮ ভাগে। গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতের রিজার্ভ ছিল ৬৪৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে ভারতের জিডিপি ছিল ৩ হাজার ৪১৭ বিলিয়ন ডলার, যখন বাংলাদেশের তা ৪৬০ বিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ ভারতের অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে সাত থেকে আট গুণ বড়। সে হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ থাকা উচিত ছিল ৮০ থেকে ৯০ বিলিয়ন ডলার। অথচ বাংলাদেশ ১৯-২০ বিলিয়ন ডলারে হাবুডুবু খাচ্ছে। বড়জোর গ্রস হিসাবে ২৫ বিলিয়ন ডলার ধরলেও, তা ৮০ বিলিয়নের ধারেকাছে নেই। অন্য উন্নয়নশীল দেশকে টেনে এনে দল ভারী করে লাভ নেই। তারা সমস্যাগুলো তাদের মতো করে অর্থশাস্ত্র মেনেই সমাধান করেছে বা করে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কা এর আরেক প্রমাণ।
মাত্র দু-এক মাস আগে জ্বালানি উপদেষ্টা বললেন যে পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের অনেকটা মাথার ওপর বাড়ি মেরে ১৪ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত নিয়ে গেছে, যার জন্য আজকে এই সংকট। এর জন্যই নাকি ম্যাক্রো অস্থিতিশীলতা।
লক্ষ করলাম, কোনো অর্থনীতিক এহেন গবেষণাহীন, অস্পষ্ট ও উদ্ভট ব্যাখ্যার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি।
ধরুন, এক দম্পতি থাকে মোহাম্মদপুর। স্বামী ভদ্রলোক নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। কিন্তু মূল্যস্ফীতিতে তাঁদের সংসারে সঞ্চয় কমে গেছে। কমে গেছে ক্রয়ক্ষমতা। বেড়েছে অশান্তি। ভদ্রলোক যদি তাঁর স্ত্রীকে বলেন যে গত দুই বছরে মাছ বিক্রেতারা তাঁর কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা বেশি নিয়ে গেছে বলেই তিনি অর্থসংকটে পড়েছেন, তা যে রকম হাস্যকর, উপদেষ্টা মহোদয়ের বক্তব্যও ঠিক সে রকম। যাঁর প্রয়োজন, তিনিই কিনবেন। দোকানি কাউকে বাধ্য করেননি।
বাংলাদেশ তেল কিনেছে, কারণ সেই তেল ব্যবহার করে ভোগ ও বিনিয়োগ বেড়েছে। কেউ দাম বাড়ালেও আমরা যদি তেল কিনে থাকি, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের জন্য তা দরকারি।
কোভিড-উত্তর অর্থনীতি যখন নবগতিতে উজ্জীবিত হয়ে উঠছিল, ঠিক তখন ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ ভ্লাদিমির পুতিন পাকিস্তানি বাহিনীর স্টাইলে ইউক্রেন আক্রমণ করে বসলেন। আমাদের দেশের অনেকে এটিকে ‘পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ’ বলতে শরম পান। বলেন ‘ইউক্রেন যুদ্ধ’।
শুনে মনে হয় ইউক্রেনই যুদ্ধটা বাধিয়েছে। ঠিক তখন রাশিয়ার নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তেলের দাম বাড়িয়ে দিল। মার্কিন বিক্রেতারাও তেলের দাম বাড়ালেন। কারণ, জোগান ও কাঁচামালের দাম বেড়েছে। বাংলাদেশ বর্ধিত দামে কিনতে বাধ্য হয়েছে, ঠিক যেমন নগরবাসী উচ্চ দামে সবজি কিনতে বাধ্য হন। এ জন্য সবজি বিক্রেতা ষড়যন্ত্রকারী নন।
বাংলাদেশ তেলের এই বর্ধিত দামের দেনা শোধ করেছে চলতি হিসাবের মধ্য দিয়ে। কোনো কোম্পানি এসে বন্দুক ঠেকিয়ে আদায় করে নিয়ে যায়নি। কিন্তু সংকট সে কারণে প্রকট হয়নি। এখানে বিজ্ঞ উপদেষ্টা একটি দেশের লেনদেনের ভারসাম্যের হিসাব বুঝতে পারেননি।
সংকট মূলত ঘনীভূত হয়েছে, যখন বাংলাদেশের আর্থিক হিসাবে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি হয়ে গেল। রাতারাতি ১৫ বিলিয়ন ডলারের ভরা আর্থিক খাত শূন্য হয়ে গেল। কয় দিন বাদে ঋণাত্মক দুই বিলিয়নে নেমে গেল। এটি আগে কখনো দেখা যায়নি।
সংকটের মূল ধাক্কা এখান থেকেই, যা গভর্নরও উল্লেখ করেছেন। আসুন দেখি এর পেছনে কোন পশ্চিমা ষড়যন্ত্র রয়েছে! উপদেষ্টাকে নিরাশ করে বলছি, পুঁজিপ্রবাহের স্বাভাবিক নিয়মেই হয়েছে—বাইরের উচ্চ সুদ পুঁজি টেনে নিয়ে গেছে। তখন আমরা সুদের ওপর জোর করে টুপি পরিয়ে রেখেছিলাম। যাঁরা এই স্বাভাবিক নিয়মটি বোঝেন না, তাঁরা আপাতত ‘কনস্পিরেসি থিওরি’র আশ্রয় নিয়ে নিজের নীতিজড়তার দোষ ঢাকার চেষ্টা চালাতে পারেন বৈকি।
এরপর উপদেষ্টার আরেক অভিযোগ ‘জিওপলিটিক্যাল ফ্যাক্টর’। আমেরিকা কেন সুদের হার বাড়াল? এতে ডলার শক্তিশালী হয়ে আমাদের টাকাকে দুর্বল করে দিল।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কেন তখন সুদহার বাড়াল না। সারা পৃথিবীই তো সুদহার বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র শতকরা দুই ভাগ মূল্যস্ফীতির দেশ। সেই দেশে পুতিন-চালিত আক্রমণোত্তর যুগে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ ভাগে উঠে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানতে দ্রুত সুদহার বাড়াতে লাগল। এটি অর্থনীতির নিয়ম।
রক্তচাপ বেড়ে গেলে শরীরকে ছলেবলে কৌশলে শান্ত করতেই হবে। না হলে মৃত্যু। অর্থনীতির টেইলর রুল যা বলেছে, ওদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রেখে তা-ই করেছে। মনে হচ্ছে, ফেড রিজার্ভের চেয়ার জেরোমি পাওয়েল ওদের সুদহার বাড়ানোর আগে কেন যে বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টার কাছে জিজ্ঞাসা করে নিলেন না—এটি মহা অন্যায় হয়ে গেছে।
অর্থশাস্ত্রের নীতিগুলো মেনে চললেও কোনো দেশ বিপদে পড়তে পারে, কিন্তু সংকট ততটা প্রকট হয় না। অন্যদিকে নীতিগুলোর তোয়াক্কা না করে বা উল্টো পথে চলে সংকট ঘনীভূত করার পর পাশের বাড়ির মোড়লের ওপর দোষ চাপানো সুস্থ যুক্তিবোধের লক্ষণ নয়। নিজেদের নীতিভ্রান্তি ও নীতি অস্থিরতার ফল আজকের এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ডলার-সংকট।
জ্ঞানী-গুণী দেখেই প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় তাঁর উপদেষ্টাদের নিয়োগ দিয়েছেন। এই উচ্চ শ্রেণির পরামর্শকেরা তাঁদের কথাবার্তায় জ্ঞান ও গবেষণার যথার্থ প্রতিফলন ঘটিয়ে জাতিকে পথ দেখাবেন—এটিই তো আমাদের প্রত্যাশা। লিখেছেন, বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক।
আপনার মতামত জানানঃ