প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসে ২০১৪ সালে। তখন থেকেই ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলিম কঠিন সময়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছেন। হিন্দুত্ববাদী নজরদারিকারীরা গরু ব্যবসায়ী সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করেছে ব্যবসায়ীদের।
টার্গেট করেছে মুসলিম মালিকানাধীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। মসজিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। অনলাইনে মুসলিম নারীদেরকে ‘নিলামে’ বিক্রি করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীনে ভারতে মুসলিমদের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে অনলাইন বিবিসিতে এসব কথা লিখেছেন স্বতিক বিশ্বাস।
‘ইনভিজিবল ইন আওয়ার ওন কান্ট্রি’: বিং মুসলিম ইন মোদিস ইন্ডিয়া- শীর্ষক প্রতিবেদনে তিনি আরও লিখেছেন, ‘জিহাদ’ ‘লাভ জিহাদ’কে ইসলামভীতি হিসেবে উস্কানি দিয়েছে উগ্র ডানপন্থি গ্রুপগুলো এবং মূলধারার মিডিয়ার কিছু অংশ। উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, হিন্দু নারীদের বিয়ে করে মুসলিমরা ধর্মান্তরিত করছেন বলে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়েছে। স্বতিক বিশ্বাস আরও লিখেছেন, ৬ বছর আগে উত্তরের শহর আগ্রায় সুপরিচিত একটি স্কুলে একটি মুসলিম বালকের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল।
৯ বছর বয়সী ওই বালক তার মাকে বলেছে- সহপাঠীরা আমাকে একজন পাকিস্তানি সন্ত্রাসী হিসেবে ডাকে। তার মা রীমা আহমেদ একজন লেখিকা, কাউন্সেলর। ওই দিনের কথা তার খুব মনে আছে। তিনি বলেন, সে একটি ছোট্ট বালক।
তার হাতের কব্জা এত শক্ত করে ধরা হয়েছিল যে, আঙ্গুলগুলো তার হাতে বসে গিয়েছিল। এতে সে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। তাকে নিয়ে যখন সহপাঠীরা এমন উপহাসে মত্ত তখন একজন শিক্ষক এগিয়ে যান। তখন বালকদের একটি দল আমার ছেলের দিকে ইঙ্গিত করে বলে- এটা হলো পাকিস্তানি একজন সন্ত্রাসী। তাকে হত্যা করো। এ সময় সহপাঠীদের কেউ কেউ তাকে নর্দমার কীট বলে আখ্যায়িত করে।
এ নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলেন মিস আহমেদ। তাকে বলা হয়, এমন ঘটনা ঘটেনি। এরপরই ওই স্কুল থেকে সরিয়ে আনেন মিস আহমেদ। বর্তমানে তার ১৬ বছর বয়সী এই বাচ্চাকে বাসায়ই শিক্ষা দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, আমার ছেলের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারি আমার সম্প্রদায় কেমন আছে। আমি বেড়ে ওঠার সময়ে এমন অভিজ্ঞতা আমি কখনো অনুভব করিনি। আমাদেরকে শ্রেণিকক্ষে সবসময় সুরক্ষা দেয়া হতো। কিন্তু এখন শ্রেণিকক্ষ এবং প্রাসঙ্গিকতা বলছে আরও বেশি টার্গেট করা হয়েছে।
ভারতে মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন ঘটনার চার ভাগের মধ্যে তিন ভাগই রিপোর্ট করা হয়েছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে। ‘বিং মুসলিম ইন হিন্দু ইন্ডিয়া’ বইয়ের লেখক জিয়া উস-সালাম বলেছেন, মুসলিমরা হয়ে উঠেছেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তারা এখন নিজেদের দেশে অদৃশ্য এক সংখ্যালঘু।
কিন্তু ভারতে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে ভুল আচরণ করার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নিউজ উইক ম্যাগাজিনকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এরা হলো এমন কিছু সাধারণ মানুষ, যারা তাদের বৃত্তের বাইরের লোকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দ্বিধা করে না।
এমনকি ভারতের সংখ্যালঘুরা এখন আর এই বর্ণনা খায় না। কয়েক দশক ধরে আগ্রায় বসবাস মিস রীমা আহমেদের পরিবারের। শহরের সংকীর্ণ গলি এবং গাদাগাদি করে গড়ে ওঠা বাড়িগুলোতে তার আছে অনেক হিন্দু বন্ধু। কিন্তু তিনি এখন মনে করেন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ২০১৯ সালে একটি স্কুলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যান তিনি। সেখানে মাত্র দু’জন মুসলিম বন্ধুর মধ্যে তিনি ছিলেন একজন।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানে মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে ভারত আকাশপথে হামলা চালানোর পর সেখানে একটি পোস্ট আসার পর তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যান। ওই পোস্টে লেখা হয়েছিল- যদি তারা আমাদেরকে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আঘাত করে, তাহলে আমরা তাদের বাড়িঘরে প্রবেশ করবো এবং তাদেরকে হত্যা করবো।
এ কথা যেন প্রধানমন্ত্রী মোদির কথারই প্রতিধ্বনি। তিনি সন্ত্রাসী ও পাকিস্তানের শত্রুদের বাড়িঘরে ঢুকে হত্যার বিষয়ে একই রকম কথা বলেছিলেন। রীমা আহমেদ বলেন, আমি মেজাজ হারিয়ে ফেলি। বন্ধুদের কাছে জানতে চাই তোমাদের সমস্যা কি? তোমরা কি বেসামরিক মানুষ ও শিশুদের হত্যাকে সমর্থন করো? তিনি শান্তির পথে থাকার পরামর্শ দেন। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল দ্রুততার সঙ্গে। রীমা বলেন, কেউ কেউ জানতে চাইলেন- মুসলিম হওয়ার কারণে তুমি কি পাকিস্তানপন্থি? তারা আমাকে জাতীয়তাবিরোধী বলে আখ্যায়িত করে।
হঠাৎ করেই অহিংসতার আহ্বানকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে গণ্য করা হয়। তাদেরকে আমি বলি, আমার দেশকে সমর্থন করতে আমাকে সহিংস হওয়ার প্রয়োজন নেই। এ জন্য আমি এই গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। পরিবর্তনটা অন্যভাবেও অনুভূত হয়।
মিস রীমা আহমেদের বিশাল বাড়িটি তার ছেলের সহপাঠীদের আড্ডাস্থল ছিল। এক্ষেত্রে কোনো লিঙ্গ বা ধর্মীয় বাধা ছিল না। কিন্তু এখন ‘লাভ জিহাদের’ কারণে, তিনি হিন্দু মেয়েদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর চলে যেতে বলেন। তাদেরকে তার ছেলের রুমে অবস্থান করতে বারণ করেন। আমার পিতা ও আমি ছেলের সঙ্গে বসি। তাকে বলি- পরিস্থিতি ভালো না। তোমাকে তোমার বন্ধুত্বকে সীমাবদ্ধ করতে হবে। সতর্ক হতে হবে। তুমি কখনো জানো না। পরিস্থিতি যেকোনো সময় ‘লাভ জিহাদে’ পরিণত হতে পারে। আগ্রার পঞ্চম প্রজন্মের বাসিন্দা পরিবেশ বিষয়ক অধিকারকর্মী ইরাম। তিনি স্থানীয় স্কুলগুলোতে কাজ করেন।
এ সময়ে শহরের শিশুদের মধ্যে কথোপকথনে পরিবর্তন দেখতে পেয়েছেন। একবার তিনি একটি মুসলিম শিশুকে উদ্দেশ্য করে আরেকটি শিশুকে বলতে শোনেন- আমার সঙ্গে কথা বলো না। আমার মা কথা বলতে বারণ করেছেন। তিনি বলেন, গভীরভাবে মুসলিম ভীতি থেকে তাদেরকে এড়িয়ে চলার বিষয়টি এতে প্রতিফলিত হয়েছে। ইরাম বলেন, এতে এমন কিছু গড়ে উঠছে, যা সহজে পূরণ হবে না। প্রচুর হিন্দু বন্ধু আছে ইরামের। তাদের মধ্যে তিনি একজন মুসলিম নারী হিসেবে অনিরাপদ বোধ করেন না।
এটা শুধু শিশুদের বিষয় নয়। একসময় হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে যে পুরনো সৌহার্দ্য বজায় ছিল তা নিয়ে আক্ষেপ করেন স্থানীয় সাংবাদিক এবং আন্তঃধর্মীয় আয়োজক সিরাজ কুরেশি। তিনি এমন একটি ঘটনার উল্লেখ করেন, যখন শহরের ভেতর একজন মানুষ খাসির মাংস বিক্রি করছিলেন। কিন্তু তাকে তা বিক্রি করা বন্ধ করে দেয় উগ্র ডানপন্থি হিন্দু কিছু মানুষ। তারা তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। ফলে তার স্থান হয় জেলখানা।
কিন্তু ওই ব্যক্তির মাংস বিক্রি করার যথার্থ লাইসেন্স ছিল। তা সত্ত্বেও পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ট্রেনে করে যখন ভ্রমণ করেন তখন অনেক মুসলিম যাত্রীর সঙ্গে আচরণেও পরিবর্তন দেখতে পেয়েছেন সম্প্রদায়ের অনেকে।
গরুর মাংস বহনের কথিত অভিযোগে মুসলিম যাত্রীদের ওপর হামলা করা হয়। তাই রীমা আহমেদ বলেন, আমরা এখন সতর্ক হয়ে গিয়েছি। গণপরিবহনে নন-ভেজিটারিয়ান খাদ্য এড়িয়ে চলি। যদি সক্ষম হয় তাহলে গণপরিবহন এড়িয়ে চলি। আগ্রায় সপ্তম প্রজন্মের বাসিন্দা কলিম আহমেদ কুরেশি।
তিনি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। পরে তিনি জুয়েলারি ডিজাইনার এবং সংগীতজ্ঞ হয়ে ওঠেন। সম্প্রতি আফগানিস্তানের খুবই সাধারণ একটি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে তিনি দিল্লি থেকে আগ্রার উদ্দেশ্যে একটি ট্যাক্সি শেয়ার করেন এক হিন্দু যাত্রীর সঙ্গে।
কলিম আহমেদ কুরেশি বলেন, যখন ওই ব্যক্তি আমার কাছে বাদ্যযন্ত্রের বাক্সটি দেখলেন, তা খুলতে বললেন। তার ভয় হয়েছিল যে, এর মধ্যে বন্দুক আছে। মা’র অনুভূতি বুঝতে পারি। এমন উদ্বেগের মধ্যে আমরা বসবাস করছি। এখন ভ্রমণ করার সময় সচেতন থাকতে হয় যে, আমি কোথায় আছি, কি বলতে হবে, কি করতে হবে। ট্রেনে টিকিট চেকারের কাছে নাম বলতে অস্বস্তি বোধ করি।
তিনি এসবের একটি পরিষ্কার কারণ দেখতে পান। তা হলো- সম্প্রদায়গুলোর সম্পর্কের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে রাজনীতি। বিজেপি’র মুখপাত্র সৈয়দ জাফর ইসলাম বলেন, মুসলিমদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। কাণ্ডজ্ঞানহীন মিডিয়া হাউসগুলো ইসলামভীতির খবর ছড়াচ্ছে।
কোথাও যদি একটি ছোট্ট ঘটনা ঘটে, তাহলে তাকে মিডিয়াগুলো অতিরঞ্জিত করে, যেন এমন ঘটনা এর আগে কখনোই ঘটেনি। ১৪০ কোটি মানুষের এই দেশে এমন কিছু ঘটনা সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ঘটে থাকতে পারে। এমন দুটি বা একটি ঘটনাকে আপনি ঢালাওভাবে ক্ষমতাসীন দলের মুসলিম বিরোধিতা বলে চালিয়ে দিতে পারেন না।
যদি কেউ এটাকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে টার্গেট হিসেবে উল্লেখ করে, তাহলে তারা ভুল। স্বতিক বিশ্বাস লিখেছেন, তার কাছে আমি জানতে চাইলাম- যদি তার শিশু স্কুল থেকে বাসায় ফিরে বলে যে, তাকে সহপাঠীরা পাকিস্তানি সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে শুধু ধর্মের কারণে- তাহলে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? সাবেক এই ব্যাংকার ২০১৪ সালে বিজেপিতে যোগ দেন। তার দুটি সন্তান রয়েছে। তার একটি এখন স্কুলে পড়াশোনা করে।
তিনি ওই প্রশ্নের জবাবে বলেন, অন্য পিতামাতার মতো, আমারও খারাপ লাগবে। এসব ঘটনা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব স্কুলগুলোর। পিতামাতার উচিত যাতে সন্তানরা এসব কথা না বলে তা নিশ্চিত করা। যেখানে শতকরা ৭৯ ভাগ মানুষ হিন্দু, সেই দেশে বিজেপি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার কথা বলছে।
এ বিষয়ে কি বলবেন? এর জবাবে তিনি বলেন, জনগণ জানে এ হলো বাগাড়ম্বরতা। আমাদের সরকার বা দল কি এসব কথা বলেছে কখনো? যারা এসব কথা বলে, তাদেরকে এত বেশি স্থান দেয় কেন মিডিয়া? এসব মানুষকে যখন এত স্পেস দেয় মিডিয়া, তখন আমরা হতাশ হই। বিজেপি’র কোনো মুসলিম মন্ত্রী নেই। জাফরুল ইসলাম বলেন, এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়।
মুসলিমদের ব্যবহার করছে কংগ্রেস ও বিরোধী দল। তাদেরকে ব্যবহার করে বিজেপিকে পরাজিত করতে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। যদি কোনো মুসলিম প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হয় এবং মুসলিমরা যদি তাকে ভোট না দেন, তাহলে কোন দল তাদেরকে প্রার্থী করবে? এটা সত্য যে, ২০১৯ সালের ভোটে ভারতের শতকরা মাত্র ৮ ভাগ মুসলিম ভোট দিয়েছিল বিজেপিকে। মোদির দলের বিরুদ্ধে একটি ব্লককে ভোট দেয়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২০ সালে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে শতকরা ৭৭ ভাগ মুসলিম ভোট দিয়েছেন বিজেপিবিরোধী জোটকে। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে শতকরা ৭৫ ভাগ মুসলিম সমর্থন করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসকে। ২০২২ সালে উত্তর প্রদেশে শতকরা ৭৯ ভাগ মুসলিম সমর্থন দিয়েছেন বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টিকে। (সংক্ষেপিত)
আপনার মতামত জানানঃ