পিঁপড়া থেকে মাছ, কাক, অনেক প্রাণী হাতিয়ার হিসেবে পাথর ব্যবহার করে। কিন্তু সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত শুধু মানুষ এবং মানুষের পূর্বপুরুষদের (আত্মীয় প্রজাতি) পাথরের হাতিয়ার ব্যবহারের একটি স্বীকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক রেকর্ড ছিল। এখন বিজ্ঞানীরা স্বীকার করছেন, এ ধরনের হাতিয়ার ব্যবহারে দক্ষ শুধু হোমিনিনরাই ছিল না। অর্থাৎ, শুধু মানুষ বা তাদের আত্মীয় প্রজাতিই নয়, অন্য প্রজাতিও ‘প্রস্তর যুগে’ প্রবেশ করেছিল!
সাম্প্রতিক গবেষণা দেখা গেছে, প্রস্তর যুগ মানুষের একচেটিয়া সভ্যতা নয়। শিম্পাঞ্জি, ক্যাপুচিন বানর এবং লম্বা লেজওয়ালা ম্যাকাকও প্রস্তর যুগ পার করেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ রয়েছে যে, এসব প্রজাতি অতীতে পাথরের সরঞ্জাম ব্যবহার করত। সামুদ্রিক ভোঁদড়ও সম্ভবত পরবর্তীতে এই ক্লাবে যোগ দিয়েছে।
প্রাইমেট প্রজাতির প্রতিটিরই হাতিয়ার ব্যবহারের দক্ষতা আছে। এটি সামাজিকভাবে শেখা একটি আচরণ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাইমেট প্রত্নতাত্ত্বিক ক্যাটারিনা আলমেদা–ওয়ারেন বলেন, এটি ওদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। ক্যাটারিনা শিম্পাঞ্জি নিয়ে গবেষণা করেন।
তিনি বলেন, বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন টুল ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ কিছু শিম্পাঞ্জি গোষ্ঠী নারিকেল জাতীয় ফল ভাঙার জন্য একটি সমতল পৃষ্ঠ বিশিষ্ট পাথরের ওপর রেখে আরেকটি ভারী পাথর বা শিলা দিয়ে আঘাত করার কৌশল জানে।
শিম্পাঞ্জিরা (প্যান ট্রোগ্লোডাইটস) হাজার বছর ধরে হাতুড়ি এবং পাথর বা শিলার মুগুরের মতো হাতিয়ার ব্যবহার করে আসছে। প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস জার্নালে ২০০৭ সালে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, আইভরি কোস্টের শিম্পাঞ্জিরা ৪ হাজার ৩০০ বছর আগেও শিম্পাঞ্জিরা এ ধরনের ব্যবহার করত। তথাকথিত এই ‘শিম্পাঞ্জি প্রস্তর যুগ’ আফ্রিকার চিরহরিৎ অংশে বসতি স্থাপনকারী মানুষের আগমনেরও অনেক আগের ঘটনা।
ব্রাজিলের ক্যাপুচিন বানর (সাপাজুস লিবিডিনোসাস) নারিকেল জাতীয় ফল ফাটানোর জন্য পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করে। গবেষকেরা ৩ হাজার বছর আগে ক্যাপুচিনদের ব্যবহৃত নারিকেল ফাটার কাজে ব্যবহৃত পাথর আবিষ্কার করেছেন। নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, বিভিন্ন খাবার সংগ্রহ ও প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে এদের সরঞ্জামের শৈলীগুলোতেও হাজার হাজার বছর ধরে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে।
থাইল্যান্ডের একটি সমুদ্র সৈকতে একটি গবেষক দল পাথরের হাতিয়ার খুঁজে পেয়েছেন। বলা হচ্ছে, একসময় বার্মিজ লম্ব লেজ বিশিষ্ট ম্যাকাক নারিকেল জাতীয় ফলের খোলস ছাড়ানোর জন্য এটি ব্যবহার করত। জার্নাল অব হিউম্যান ইভোলিউশনে ২০১৩ সালের একটি গবেষণাপত্র অনুসারে, এই সরঞ্জামগুলো সম্ভবত ১৯৫০ এবং ২০০৪ সালের এর মধ্যে ব্যবহার করা হয়েছে।
এই প্রাইমেটরা কীভাবে পাথরের সরঞ্জাম ব্যবহার করতে শিখেছিল তা স্পষ্ট নয়। শিম্পাঞ্জিদের ক্ষেত্রে একেবারে প্রাথমিককালের পাথরের সরঞ্জামগুলো থেকে ধারণা করা যায়, এরা ‘মুগুরের মতো বস্তু ব্যবহারের সংস্কৃতি’ মানুষ এবং শিম্পাঞ্জিদের একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিল।
তবে এটাও সম্ভব যে, মানুষ এবং শিম্পাঞ্জিরা একে অপরের থেকে স্বাধীনভাবে পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করতে শিখেছে। পাথরের হাতিয়ার ব্যবহারে দক্ষ অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও সেটিই হতে পারে।
সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী এবং প্রাইমাটোলজিস্ট তিয়াগো ফালোতিকো বলেন, পাথরের সরঞ্জামগুলো একটা অস্পষ্টতা রয়েছে। ফালোতিকো ক্যাপুচিন টুলস গবেষণার সহ–লেখক ছিলেন। তিনি বলেন, কিন্তু কোনো প্রাণী প্রজাতির ‘প্রস্তর যুগে’ প্রবেশ করার অর্থ এই নয় যে, সেই প্রজাতি শিগগিরই যে কোনও সময় মানব প্রজাতিতে উন্নীত হওয়ার পথ অনুসরণ করবে। এর অর্থ এই নয় যে, পাথরের সরঞ্জাম ব্যবহারকারীরা অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহারকারী প্রাণীর তুলনায় বুদ্ধিমান।
২০২২ সালে আর্জেন্টিনার একটি গবেষক দল অনুমান করেছিলেন, ব্রাজিলে ৫০ হাজার বছর আগের ‘মানব বসতি’ আসলে ক্যাপুচিন বানরেরাই পত্তন করেছিল। দ্য হোলোসিন জার্নালে এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। গবেষকেরা দেখেছেন, পাথরের সরঞ্জামগুলো কোয়ার্টজাইট এবং কোয়ার্টজ কোবল থেকে তৈরি। এগুলো ব্রাজিলের দ্য গ্রেট ক্যাপিভারা ন্যাশনাল পার্কে বর্তমানের ক্যাপুচিন বানরদের তৈরি সরঞ্জামগুলোর মতোই।
এ ব্যাপারে ফালোতিকো বলেন, এই গবেষণাটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। এটি নিয়ে আরও অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। কিন্তু যদি এটি সত্য হয় তাহলে, হাজার হাজার বছর ধরে পাথরের হাতিয়ার ব্যবহারে দক্ষ ক্যাপুচিন বানরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সপক্ষেই শক্ত ভিত্তি তৈরি করবে এবং ওই সময় মানুষের দক্ষিণ আমেরিকায় বসতি স্থাপন নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে সেটিই জারি থাকবে।
কোন সরঞ্জামগুলো কোন প্রজাতি ব্যবহার করত এটি জানা গেলে, অন্য প্রজাতির তৈরি সরঞ্জামগুলো পরোক্ষভাবে মানব প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কেও ধারণা দিতে পারে। আলমেইদা–ওয়ারেন বলেন, ৩৩ লাখ বছর আগের প্রাচীনতম হোমিনিন–নির্মিত সরঞ্জাম আংশিকভাবে পাওয়া যায়। কারণ প্রাইমেটদের তৈরি সরঞ্জামগুলো প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা দিতে পারে মানুষের প্রাচীন হাতিয়ার খুঁজতে তাঁদের কী সন্ধান করতে হবে।
এই গবেষক আরও বলেন, শুধু মানুষের জন্য ‘প্রস্তর যুগ’ বলে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পাথরের হাতিয়ার ব্যবহারকে বোঝানো হয়। কিন্তু মানুষ তো শুধু পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করেনি। অন্য প্রজাতিগুলোর ‘প্রস্তর যুগ’ও তেমনি। বর্তমান সময়ে প্রাইমেটদের ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলোর অধ্যয়ন গবেষকদের মানব সরঞ্জামগুলো সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে। সেগুলোর অস্তিত্ব হয়তো এখন অনেকখানিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
উদাহরণস্বরূপ, শিম্পাঞ্জিরা মাছ ধরতে গাছের লম্বা ছাল ব্যবহার করে যেগুলোর মধ্যে শুঁয়োপোকা থাকত। শুঁয়োপোকা এরা টোপ হিসেবে ব্যবহার করে। এ ছাড়া ক্ষত সারানোর জন্য এরা ঔষধি লতাপাতাও ব্যবহার করে। অনেক ক্ষেত্রে উদ্ভিদের ব্যবহার আরও জটিল বলে উল্লেখ করেন আলমেইদা–ওয়ারেন।
মানুষ ছাড়া অন্য প্রজাতির প্রত্নতত্ত্বও সময়ের সঙ্গে এই প্রজাতির আচরণের বিবর্তনের ওপর আলোকপাত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন ক্যাপুচিন বানর অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে দেখা যায়, বিভিন্ন খাবার সংগ্রহের জন্য এই বানরেরা শতাব্দী ধরে এদের হাতিয়ারগুলোতেও পরিবর্তন এনেছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকেরা দেখেছেন, সামুদ্রিক ভোঁদড়েরা পাথরের ওপর রেখে ঝিনুকের খোলস ফাটিয়ে নেয়। সায়েন্টিফিক রিপোর্ট জার্নালে ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, গবেষকেরা সামুদ্রিক ভোঁদড়ের ব্যবহৃত পাথর শনাক্ত করতে পেরেছেন।
উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূল বরাবর সামুদ্রিক ভোঁদড়ের সংখ্যা কমে গেছে। এখন যেহেতু গবেষকেরা জানেন তাঁদের কী অনুসন্ধান করতে হবে, সেহেতু ভোঁদড়ের বসতিগুলোর ইতিহাস এবং এরা যে বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করেছে সেগুলো খুঁজে বের করতে পারার আশা করছেন।
আপনার মতামত জানানঃ