দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ রোববার। বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের বর্জনের মুখে আজকের এই নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ এবং দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জোট-মিত্ররা। ফলে জয়-পরাজয় ছাপিয়ে কেন্দ্রে ভোটার আনাই মূল লক্ষ্য।
আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে দলটি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রচার, বিভিন্ন দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতার ফলে এটা স্পষ্ট যে ক্ষমতাসীনেরাই পুনরায় সরকার গঠন করবে। আজকের ভোটের মধ্য দিয়ে মূলত ঠিক হবে কারা সংসদের বিরোধী দলের আসনে বসবে। ফলে সব মিলিয়ে কেন্দ্রে ভোটার টানার দায়িত্ব মূলত আওয়ামী লীগের কাঁধেই পড়েছে।
রোববার সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ চলবে। এবার সব আসনে ভোট হবে কাগজের ব্যালটে। বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে রোববার সকালে ব্যালট পাঠানো হবে। ভোট নির্বিঘ্ন করতে বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় আট লাখ সদস্য মাঠে থাকছেন।
বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে দুই মাসের বেশি সময় ধরে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে তারা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রচারপত্র বিতরণ করছে।
অবশ্য শনিবার ও রোববার ভোটের দিন হরতাল পালন করছে তারা। এর মধ্যে ট্রেনে, বাসে, ভোটকেন্দ্রে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে আজ কী পরিমাণ ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে আসবেন, এই বিষয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না—এই অভিযোগে বিএনপিসহ কিছু বিরোধী দল ২০২১ সাল থেকেই সব ধরনের নির্বাচন বর্জন করে আসছে। এরপর থেকে সংসদের যত উপনির্বাচন হয়েছে, এর সবগুলোতেই ভোটার উপস্থিতি খুবই কম দেখা গেছে। এমনকি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেও ভোটারের উপস্থিতি ছিল কম। সর্বশেষ গত বছরের মে মাসে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সর্বাধিক ৫৮ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি ছিল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল দলটিরই স্বতন্ত্র প্রার্থী।
এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী দলেরই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাই আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘গাজীপুর মডেল’ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
বিরোধী দলগুলো এক বছরের বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশে সংঘাতের পর দলটির মহাসচিবসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে কারাগারে পাঠানো হয়। মাঠপর্যায়ের নেতারাও হয় কারাগারে নতুবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এর মধ্যে নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এনেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবার কত শতাংশ ভোট টানতে চায়, তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেনি। তবে দলটির নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য ভোট পড়ার হার যেন ৫০ শতাংশ বা এর বেশি হয়। দলটির যুক্তি হচ্ছে—২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৪০ শতাংশ। যেকোনো মূল্যে ওই নির্বাচনের চেয়ে বেশি ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ।
দলটির সূত্রগুলো বলছে, ভোটার টানতে দলের নেতাদের স্বতন্ত্র ভোট করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের প্রতিটি কেন্দ্রে অন্তত ৫০ জনের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে। এতে সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও রয়েছেন। এ ছাড়া সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় যেসব সুবিধাভোগী আছেন, তাঁদেরকেও কেন্দ্রে আনার বিষয়ে চেষ্টা-তৎপরতা আছে।
তবে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানো নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখছে আওয়ামী লীগ। কারণ, ভোটের আগে শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকায় অনেকেই শহর ছেড়েছেন। এরপর হরতাল, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনাগুলোর আতঙ্ক রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও তাঁদের কর্মীরা।
আওয়ামী লীগের বিশ্লেষণ অনুসারে, ২০০ আসনে দলটির মনোনীত প্রার্থীদের তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ফলে এসব আসনে ভোটার কতটা আগ্রহী হবে—সেই শঙ্কাও আছে। জাপা ও ১৪ দলকে ৩২টি আসনে ছাড় দেওয়ায় সেগুলোতে নৌকার প্রার্থী নেই। ফলে শরিকেরা কতটা ভোটার টানতে পারবে, সেটাও ভাবনায় রেখেছে আওয়ামী লীগকে।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এবার আওয়ামী লীগসহ ২৮টি দল ভোটে অংশ নিয়েছে।
অতীতের নির্বাচন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভোটে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকিদের তেমন জনসমর্থন নেই। সর্বশেষ তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ভোটে অংশ নিয়ে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ভোট ছিল ৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে। এই তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া যেসব আসনে জাতীয় পার্টি লড়েছে, সেখানে তাদের প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। এর বাইরে ভোটে অংশ নেওয়া অন্য দলগুলোর সবারই ভোট পাওয়ার হার নগণ্য।
এমন অবস্থায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অবশ্য এবার যাতে কেউ বিনা ভোটে নির্বাচিত না হন, সে বিষয়ে সতর্ক আওয়ামী লীগ। যার কারণে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েই দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। ২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন ভোটে ১৫৩ আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে সমালোচনার জন্ম দেন।
এবারের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কূটনীতিকেরা প্রায় এক বছর ধরেই দৌড়ঝাঁপ করছেন। চাপ প্রয়োগের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র গত মে মাসে ভিসা নীতি ঘোষণা করে। এতে বলা হয়, রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের যাঁরা নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করবেন, তাঁদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র।
এ ছাড়া সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে গত ১৩ নভেম্বর জাপা ও বিএনপিকে এবং ১৫ নভেম্বর আওয়ামী লীগকে চিঠি দিয়ে নিঃশর্ত সংলাপের আহ্বান জানায় যুক্তরাষ্ট্র। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যেদিন চিঠি গ্রহণ করেন, ওই দিনই সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
এর আগে-পরে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাও সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে আহ্বান জানিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলের বর্জনের মধ্য দিয়েই আজ ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের চিন্তা হচ্ছে, ভোটে বিরোধী দল না থাকলেও সমস্যা নেই। ভোটার উপস্থিতি বেশি দেখাতে পারলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। এ ছাড়া ভোটের দিন সংঘাত এড়ানো এবং ভোট জালিয়াতি যাতে না হয়, সেটাও আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। নির্বাচন কমিশনও এই ব্যাপারে কঠোর হওয়ার কথা জানিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এ নির্বাচনে ফলাফলের চেয়ে ভোটারের উপস্থিতি এবং ভোট কতটা শান্তিপূর্ণ হয়েছে, সেদিকেই দেশ-বিদেশের নজর থাকবে।
আপনার মতামত জানানঃ