সভ্যতা অনেকটা পথ চলে এসেছে। তবু আজও কালো জাদু খবরের শিরোনামে। কিছুদিন আগেও ভারতের গুজরাটে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ‘ভূতে ধরেছে’ এই সন্দেহে কিশোরী মেয়েকে খুন করার অভিযোগ উঠেছে।
তিনিও নাকি কালো জাদু প্রয়োগ করে ভূত তাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে তথাকথিত ‘রেনেসাঁ’র আগে পৃথিবীতে ছেয়ে গিয়েছিল এই ধরনের জাদুর চর্চা। এত বছর পেরিয়েও সেই ব্যাধিকে হারানো যায়নি।
পৃথিবীর সব দেশেই কালো জাদুর চর্চার ইতিহাস রয়েছে। কীভাবে জন্ম হয়েছিল এর? রবার্ট এম প্লেসের বিখ্যাত বই ‘বুক, ম্যাজিক অ্যান্ড অ্যালকেমি’তে বলা হয়েছে আত্মার আদিম, আচারিক উপাসনাই জন্ম দিয়েছিল সাদা ও কালো দুই জাদুরই।
সেখান থেকেই বইতে বইতে আধুনিক সময়েও প্রবেশ করে কালো জাদু। এর পিছনে অন্যতম উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে আত্মাকে (অথবা অন্য লোকের বাসিন্দা অপশক্তিকে) বন্দি করে তার সাহায্যে অন্যের ক্ষতিসাধন করা কিংবা নিজের কোনো হিতসাধন। সাধারণ ভাবে সাদা জাদুকে উঁচু শ্রেণির জাদু ধরা হয়।
একই ভাবে কালো জাদুকে নীচু শ্রেণির জাদু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দুই জাদুর উদ্দেশ্যগত ফারাকের কারণেই এই শ্রেণিবিভাগ। যদিও এই বিভাজন এতই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম, যে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে এদের আটকে রাখা মুশকিল। বিশেষ করে ভালো উদ্দেশ্যে যে জাদুর জন্ম, সেই জাদুকেই খারাপ কাজে ব্যবহার করার উদাহরণ কম নেই।
‘কালো জাদু’র কথা বলতে বসলেই উঠে আসে উইচক্র্যাফট তথা ডাকিনীবিদ্যা কিংবা স্যাটানিজম অর্থাৎ শয়তানের উপাসনার প্রসঙ্গ। মধ্যযুগে ইউরোপ জুড়ে বিশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছিল, মহামারি ও অন্যান্য দুর্যোগের মূলে আসলে শয়তানরা। আর তাই ক্যাথলিক চার্চ শুরু করে ‘উইচ হান্ট’।
ধরে ধরে ‘ডাইনি’ তথা ডাইনি বিদ্যা চর্চাকারীদের খুঁজে বের করে তাদের হত্যা করা। বহু নিরপরাধ মানুষের প্রাণ গিয়েছিল ইনকুইজিশনের নিষ্ঠুর রক্তচক্ষুর কবলে পড়ে।
এই সংক্ষিপ্ত লেখায় খুব বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তবু একবার উঁকি দেওয়া যেতেই পারে স্যাটানিজমের দিকে। এই শয়তানবাদের প্রচারকদের পূজ্য যে শয়তান তা বলাই বাহুল্য। খ্রিষ্টান ধর্ম তো বটেই, ইসলামেও উল্লেখ রয়েছে শয়তানের।
আব্রাহামিক ধর্মে শয়তানকে বিপথগামী দেবদূত হিসেবে দেখানো হয়েছে। তার কাজই মানুষকে পাপের উসকানি দেওয়া। শয়তানের ভক্তরা মনে করে তার উপাসনা করলে কালো জাদুর শক্তি অর্জন করে অমিত বলশালী হওয়া যায়। এই মতবাদকে থেইস্টিক স্যাটানিজম বলে।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়তেই পারে ‘রোজমেরিস বেবি’ (১৯৬৮) অথবা হিন্দি ছবি ‘পরি’র (২০১৮) কথা। সেখানে শয়তানের ঔরসে নারীর অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে। এর পাশাপাশি রয়েছে অ্যাথেইস্টিক স্যাটানিজম। এটা আবার সেই অর্থে কোনও ধরনের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত নয়। এই মতবাদীদের বিশ্বাস, শয়তান আসলে মানুষেরই সুপ্ত প্রবৃত্তিরই প্রতিফলন।
১৯৬৯ সালে লেখা ‘স্যাটানিক বাইবেল’ নামের বইয়ে বিখ্যাত কালো জাদুবিদ অ্যান্টন লাভে লিখছেন, ‘সাদা জাদু ব্যবহৃত হয় ভালো তথা স্বার্থহীন উদ্দেশ্যে। এবং কালো জাদু, আমরা বলে থাকি, খারাপ উদ্দেশ্যে। শয়তানবাদে এমন কোনো সীমারেখা নেই।
জাদু শেষ পর্যন্ত জাদুই। সেটা কাউকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতে পারে কিংবা কাউকে রুখতে। একজন শয়তানবাদী, জাদুকর হিসেবে, সিদ্ধান্ত নেবে সে জাদুশক্তিকে কীভাবে ব্যবহার করবে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে।’
কালো জাদুর কথা বলতে বসলে সাধারণ ভাবে যে ছবিগুলো ভেসে ওঠে, সেখানে ভুডু থাকবেই। পপুলার কালচারে ব্ল্যাক ম্যাজিকের অন্যতম প্রতিনিধি ভুডু। ভুডুর অবশ্য স্বতন্ত্র ইতিহাস রয়েছে। যার সঙ্গে উইচক্র্যাফটের সম্পর্ক সামান্যই।
কিন্তু কালো জাদুর সঙ্গে এই বিদ্যা ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে। পশ্চিম আফ্রিকার এক ছোট দেশ বেনিনে এই ভুডুর জন্ম। পাশাপাশি নাইজেরিয়া, টোগোর মতো দেশেও জীবনযাত্রা, সাংস্কৃতিক ও আচারগত বিশ্বাসের সঙ্গে মিশে রয়েছে ভুডু।
এই বিদ্যার চর্চা যেমন দুর্বোধ্য, তেমনই রহস্যময়। সুচ বেঁধানো ভুডু পুতুলের ছবি আমাদের চেনা। খারাপ আত্মাকে ওই পুতুলের মধ্যে বন্দি করা কিংবা কারও ক্ষতি করতে তার প্রতিভূ হিসেবে পুতুলটির ক্ষতি করার অনুশীলনের কথা আমরা জানি।
যদিও বলা হয়, পশ্চিমি দেশগুলো ভুডুকে এভাবেই বাকি বিশ্বের কাছে তুলে ধরলেও আসলে ভুডুচর্চায় ভালো আত্মাকে ডেকে এনে জীবনকে মঙ্গলময় করে তুলতে চাওয়াই মূল লক্ষ্য।
এভাবেই এত হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবী নানা আলোছায়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললেও কালো জাদু রয়ে গিয়েছে। সেই আদিম কাল থেকেই জাদুর কারসাজিতে নানা ‘অলৌকিকে’র দাবি করে বহু মানুষকে ঠকিয়ে এসেছে বুজরুকরা।
আজও যে সেই সময় থেকে আমরা খুব বেশি এগোতে পারিনি তার প্রমাণ সাম্প্রতিক ঘটনাবলি। চাঁদের মাটিতে পা রাখার পাঁচ দশক পেরিয়ে এসেও খবরের শিরোনামে উঠে আসছে যৌবন এবং ভাগ্য ফেরাতে অন্যের জীবন বিপন্ন করার ভয়ংকর প্রবণতা ও অন্ধ বিশ্বাসের কাহিনি।
কবে এই জট থেকে মুক্তি পাবে সভ্যতা? প্রশ্নটা যতই সহজ হোক উত্তর আজও অজানাই।
এসডব্লিউএসএস/২১৫৫
আপনার মতামত জানানঃ