“আমি একদিন ঘড়ি ধরেছিলাম, যে অপারেশনটা আমি করেছি। ইট টেইকস এট লিস্ট টোয়েন্টি মিনিটস, এট লিস্ট টোয়েন্টি মিনিটস। টোয়েন্টি মিনিটস পর্যন্ত একটা শব্দ আসতে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে শেষ। একটা গোঙ্গানির শব্দ। কারণ হার্টতো আর পাম্প করতে পারেনা ব্লাড, সো কন্ঠ থেকে একটা শব্দ বের হতে থাকে, আপনি বুঝবেন ওই মানুষটা অক্সিজেন খুঁজছে কিন্তু অক্সিজেন পাচ্ছে না।”
নেত্র নিউজ ও ডয়চে ভেলের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কাছে এভাবেই সাজানো ক্রসফায়ারে একজন মানুষের মৃত্যুর মুহূর্তটি বর্ণনা করছিলেন র্যাবের একজন সাবেক কমান্ডার, যিনি নিজেই প্রত্যক্ষভাবে একাধিক ব্যক্তিকে ক্রসফায়ারে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
বেশ কয়েক বছর আগে সুইডিশ রেডিওতে একজন র্যাব কর্মকর্তার ভাষ্যে বাহিনীটির বিভিন্ন অপরাধের বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছিল। তবে ওই ভাষ্য ধারণ করা হয়েছিল গোপনে; অর্থাৎ সেই কর্মকর্তার অগোচরে।
এই প্রথম র্যাবের সাবেক দুই কর্মকর্তা নিজেদের পরিচয় নিশ্চিত করে সংবাদমাধ্যমের কাছে ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করার পুরো প্রক্রিয়াটি বর্ণনা করেছেন। তাদের একজন সরাসরি ক্রসফায়ারের নামে সাজানো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। আরেকজন খুব কাছে থেকে এমন হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ করেছেন। তাদের বক্তব্যে অভিযোগ উঠেছে যে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা মোতাবেকই র্যাব রাজনৈতিক বিরোধী নেতা-কর্মীদের হত্যা করে থাকে।
এই সাবেক র্যাব কমান্ডারদের ভাষ্য এবং প্রখ্যাত জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের সঙ্গে আমাদের যৌথ অনুসন্ধানে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের এক বিভীষিকাময় চিত্র উঠে এসেছে।
জল্লাদ বাহিনী
ক্রসফায়ারের নামে কথিত সন্ত্রাসী বা অপরাধীদের হত্যার কারণে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং গণমাধ্যমগুলো ২০০৪ সাল থেকেই র্যাবকে একটি রাষ্ট্রীয় জল্লাদ বাহিনী বা ডেথ স্কোয়াড হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও বলপূর্বক অন্তর্ধান বা গুমের সাথে জড়িত থাকায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের রাজস্ব মন্ত্রণালয় র্যাবের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করে।
কিন্তু এই প্রথমবারের মতো র্যাবের বিচার-বহির্ভূত হত্যার কার্যপ্রণালীর বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। এর একটি কারণ, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনাটি সংগঠিত করার ক্ষেত্রে কোনো দালিলিক প্রমাণ যেন না থাকে সেটি নিশ্চিত করা হয়। প্রমাণ ও দালিলিক ছাপ মুছে ফেলতে বা নষ্ট করতে পুরো বিষয়টি হয়ে থাকে অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায়। তাই সাবেক দুই র্যাব কর্মকর্তার কাছ থেকে পাওয়া এই জবানবন্দি ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে র্যাবের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়ে দীর্ঘদিনের বিস্তর অভিযোগ ও প্রমাণকে আরও জোরালো করবে।
এই দুই সাবেক র্যাব কর্মকর্তার পরিচয় সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তারা যেই বাহিনী থেকে র্যাবে প্রেষণে গিয়েছেন, সেই বাহিনীর কর্মকর্তাদের সরকারি গোপন তালিকা আমাদের হাতে রয়েছে। সেই তালিকায় তাদের নাম, সার্ভিস নম্বর ও অন্যান্য বিস্তারিত তথ্য মিলিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরই তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়।
র্যাবে তারা ছিলেন কমান্ডার বা অধিনায়ক পর্যায়ের কর্মকর্তা। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে তাদের নামপরিচয় ও র্যাবে থাকাকালীন অন্যান্য বিস্তারিত তথ্য গোপন রাখতে আমরা সম্মত হয়েছি।
যেভাবে ক্রসফায়ার সংগঠিত হয়
এই দুই হুইসেলব্লোয়ারের ভাষ্য অনুযায়ী, একজন ব্যক্তিকে হত্যা করার আগে র্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের সহায়তায় তাকে কিছুদিন নজরদারিতে রাখা হয়। র্যাবের পরিভাষায় এমন ব্যক্তিদেরকে বলা হয় “টার্গেট”। র্যাবের এই দুই কমান্ডারই ভিন্ন ভিন্ন দিনে আলাদাভাবে নেয়া দুইটি সাক্ষাৎকারে আমাদেরকে নিশ্চিত করেছেন যে একজন “টার্গেটকে” তুলে নেওয়ার আগে বাংলাদেশ সরকার তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে “ক্লিয়ারেন্স” বা অনুমতি নিতে হয়। বিশেষত, “টার্গেট” যদি কোনও রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ হয়ে থাকেন, তাকে হত্যার সিদ্ধান্তটি সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেই আসে।
এই প্রসঙ্গে এই দুই কমান্ডারের একজন বলেন, “পলিটিক্যাল যে কোনো টার্গেটের এনগেজমেন্টের ডিসিশান সর্বনিম্ন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আসবে, অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই আদেশটা প্রদান করে থাকেন।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন এমন সিদ্ধান্ত দেন, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষেই তা করে থাকেন বলে তার দাবি: “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি কোনো একটা আদেশ প্রদান করে থাকেন, সেটা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অগোচরে হয়েছে এমন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।”
তবে তাদের ভাষ্যের এই অংশটুকু নেত্র নিউজ ও ডয়চে ভেলে স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করতে সক্ষম হয়নি। এ বিষয়ে দেয়া লিখিত বক্তব্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এই ধরণের দাবি “বিদ্বেষপ্রসূত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত”।
র্যাবের সাবেক এই দুই কমান্ডার শুধু হত্যাকাণ্ডের চেইন অব কম্যান্ড নিয়েই কথা বলেননি, তারা বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্লেবুক অর্থাৎ বিভিন্ন ধাপ ও কার্যপ্রণালী নিয়েও বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন।
তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, শুরুতেই র্যাবের একটি দল টার্গেটকে আটক করে নিকটস্থ র্যাব ক্যাম্প বা ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে অবস্থিত গোপন বন্দীশালায় নিয়ে যায়। কয়েক ঘন্টা বা কয়েক দিন আটক রাখার পরে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কালো-টিন্টেড গ্লাসের “সিভিল” (সরকারি নয় এমন) গাড়িতে করে হত্যাকাণ্ডের জন্য আগে থেকেই নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় আগে থেকেই পাঠানো র্যাবের আরেকটি দল ওই স্থানটিতে প্রবেশের সব রাস্তায় ব্যারিকেড স্থাপন করে এবং টহলের মাধ্যমে ওই স্থানে জনসাধারণের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়।
হুইসেলব্লোয়ারদের ভাষ্য অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ডের জন্য স্থান নির্ধারণের সময় র্যাবকে চারটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়: স্থানটি হতে হবে জনশূণ্য ও লোকালয় থেকে দূরে; স্থানটিতে সহজে টহল দেয়া যাবে; স্থানটির আশেপাশে কোন ধরণের সিসিটিভি বা ক্যামেরা থাকা যাবে না; এবং, স্থানটি আগে থেকেই কয়েকবার পরিদর্শন করা হয়েছে এমন হতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এমন স্থান পাওয়া বেশ কঠিন। তাই দেখা যায় যে দাপ্তরিক ও কৌশলগত কারণে কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানেই ঘুরেফিরে এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটানো হয়। র্যাবের কর্মকর্তাদের ভাষ্য মতে, এমন কয়েকটি স্থান হচ্ছে: কক্সবাজার-টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ, ঢাকার হাতিরঝিল, রায়েরবাজারের বধ্যভূমি এবং তুরাগ নদীর তীরের বেড়িবাঁধ এলাকা।
তারা আরও বলেন, কালো গ্লাসের গাড়িতে করে “টার্গেট” ব্যক্তিকে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যাওয়ার পরে বিশেষ একটি জল্লাদ দল — র্যাবের পরিভাষায় “এফএস টিম” — তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনে। এ সময় ওই ব্যক্তির হাত, পা এবং চোখ পাতলা কাপড়, তোয়ালে বা গামছা দিয়ে বাঁধা থাকে যেন তার শরীরের কোন অংশে কোন দাগ না পড়ে। এর পর তাকে মাটিতে নিল ডাউন পজিশনে (হাঁটুর ওপর ভর করে) বসানো হয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলি করা হয়। গুলি করার সময় এক থেকে দুই ফিটের একটি দূরত্ব বজায় রাখা হয় যেন পিস্তলের মাজল ফ্ল্যাশ ওই ব্যক্তির শরীর বা কাপড়ের কোন অংশে কোন দাগ তৈরি না করে। সাধারণত ভুক্তভোগীর শরীরের উপরের অংশে বেশ কয়েকটি গুলি করা হয় এবং গুলির কারণে সৃষ্ট ক্ষত থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে সেখানেই ফেলে রাখা হয়।
র্যাবের দুই কমান্ডারের একজনের ভাষ্য, “রক্তক্ষরণটা যেন দ্রুততার সাথে ঘটে এই কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বুকে এবং হৃদপিন্ডের কাছাকাছি অংশে ফায়ার করা হয়ে থাকে।”
নেত্র নিউজ ও ডয়েচে ভেলের হাতে আসা কক্সবাজারে নিহত কাউন্সিলর একরামুল হকের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এই দাবির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে একরামুলের দেহের উপরের অংশে বুকের বাম দিকে, বুকের ডান দিকে ও পেটের বাম পাশে গুলি করা হয়েছিল। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় “গুলির কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ”।
সাজানো ক্রসফায়ারে হত্যার পর বিষয়টিকে একটি “সত্যিকার বন্দুকযুদ্ধে”র রূপ দিতে শুরু হয় আলাদা তৎপরতা।
কমান্ডারদের ভাষ্যে, ভুক্তভোগীকে যদি অস্ত্র সংক্রান্ত কোন মামলায় ফাঁসানোর পরিকল্পনা থাকে তাহলে তার মৃতদেহের আশেপাশে পিস্তলের খালি কার্তুজ ফেলে রাখা হয় এবং হাতে একটি পিস্তল দেয়া হয়। যদি ভুক্তভোগীকে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে উপস্থাপনের উদ্দেশ্য থাকে তাহলে তার পরিধেয় কাপড়ের পকেটে বা তার মৃতদেহের পাশে একটি ব্যাগে মাদক রেখে দেয়া হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে নিজেদের একটি ভাষ্য তৈরি করে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করা হয় বলে জানান তারা।
সাবেক এই র্যাব কমান্ডারদের ভাষ্য, একরামুল হকের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং ওই হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন পর তার স্ত্রীর প্রকাশ করা বহুল আলোচিত অডিও একটি টেপ একসাথে বিশ্লেষণ করলে ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডের একটি প্যাটার্ন বা সাধারণ ধরণ পাওয়া যায়।
এসডব্লিউএসএস/১৯৩০
আপনার মতামত জানানঃ