কলকাতায় যৌনপল্লীর সংখ্যা অনেক। উত্তর থেকে দক্ষিণে এই শহরে গণিকালয়গুলিতে কাজ করেন প্রায় হাজার আশি যৌনকর্মী। মূলত প্রাচীন কলকাতার দুটি রাস্তার ধারে গড়ে উঠেছিল মহানগরীর সমস্ত যৌনপল্লী।
প্রথমটি হল চিৎপুর থেকে কালীঘাটগামী রাস্তা। আর পরেরটি লালদিঘি থেকে বউবাজারগামী রাস্তা। এছাড়া বন্দরের নাবিকদের জন্য খিদিরপুর, ইংরেজদের ‘আপ্যায়নের’ জন্য জানবাজার ইত্যাদি অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল গণিকালয়।
অনেক ইতিহাসবিদের মতে, পূর্বে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ও পশ্চিমে চিতপুরের মাঝের পুরো জায়গাটা নিয়েই পতিতাদের উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। আর মজার বিষয় হল, সেই জায়গার প্রকৃত মালিক ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। আর এই উপনিবেশ বা নিষিদ্ধ পল্লীর স্থাপনাই হয়েছিল নাকি সেই জমিদার ‘বাবু’র উদ্যোগেই।
কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, সেই আমলে বিখ্যাত “বাবু” সম্প্রদায়ভুক্ত বাঙালিদের বেশির ভাগ বাবুদের একাধিক উপপত্নী থাকাটা ছিল সে সময়ের “বাবু কালচার”। সেকালের বাবুদের বারবনিতা-বিলাস ছিল রীতিমতো একটা ব্যাপার। কিন্তু ঘরে পত্নীর সঙ্গে তো আর উপপত্নী রাখা যায় না । সেই ‘সমস্যা’র কথা মাথায় রেখে “বাবু সম্প্রদায়” তাদের উপপত্নীদের রাখার ব্যবস্থা করলেন বর্তমানের “সোনাগাছি”-তে ।
কলকাতার সেন্ট্রাল এভিনিউ থেকে শোভাবাজারের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললে, পথে পড়ে গৌরী শঙ্কর লেন। এখানেই অবস্থিত এশিয়ার সর্ববৃহৎ যৌনপল্লী সোনাগাছি। আজও সাধারণ মানুষের কাছে যারা পরিচিত তথাকথিত ‘বেশ্যা’ নামে; এই অঞ্চলটির সঙ্গে যুক্ত এমনই ১০০,০০ যৌনকর্মীর নিত্যদিনের রুটিরুজির গল্প।
উনিশ শতক বললেই আমাদের মনে পড়ে ঠাকুরবাড়ির কথা। রবীন্দ্রনাথ থেকে অবনীন্দ্রনাথ একঝাঁক ক্ষণজন্মা প্রতিভার বিচরণভুমি এই ঠাকুরবাড়ি। তবে ঊনবিংশ শতকের ঠাকুরবাড়ি নিজেদের শুধুমাত্র সাহিত্য-সংস্কৃতি বা বিজ্ঞানচর্চার মধ্যে আবদ্ধ রেখেছিল ভাবলে ভুল ভাবা হবে।
সাহিত্য সংস্কৃতির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেও ঠাকুরবাড়ি ছিল একমেবাদ্বিতীয়ম। আর এই ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে তৎকালীন বাঙালি সমাজের পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন দ্বারকানাথ।
সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ঠাকুরবাড়ির জানা অজানা’ বইতে লিখেছেন, দ্বারকানাথ যখন পৈতৃক বিষয় পান তখন তার আয় ছিল খুবই অল্প। কিন্তু নিজের দক্ষতা, কার্য-কুশলতার মধ্যে ও ইংরেজ বন্ধুদের সাহায্যে তিনি একে একে বহু ভূসম্পত্তির অধিকারী হন। ওড়িশা ও পূর্ববঙ্গে তিনি বহু জমিদারি কেনেন ও সেইসব জায়গায় কুঠিবাড়ি নির্মাণ করেন।
দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বিরাট বাগানবাড়ির তো খুবই নামডাক। সেখানে এক এক রাতে তিনি যেভাবে সাহেব-সুবোদের অ্যাপায়ন করেছেন তার বিবরণ তখনকার দৈনিক পত্রিকাগুলির শিরোভাগে জায়গা পেত। আবার তা ঈশ্বর গুপ্তের ব্যঙ্গ কবিতার বিষয়বস্তুও হয়ে উঠেছিল।
এবার আসা যাক সোনাগাছির প্রসঙ্গে। ১৮৫৩ সালে প্রকাশিত একটি সার্ভে রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কলকাতা শহরে ৪৪৪৯টি ঠেক আছে, যেখানে বসবাস করেন প্রায় ১২,৪১৯ জন যৌনকর্মী। যার মধ্যে অন্যতম সাড়া জাগানো যৌনপল্লী ছিল ‘সোনাগাছি’।
সোনাগাছির সম্পর্কে কথিত ছিল, প্যারিসের যৌনকর্মীরাও কলকাতার এই যৌনালয় সম্পর্কে জানতেন। বস্তুতপক্ষে তার আগেই দ্বারকানাথ ঠাকুর বেশ কিছু যৌনপল্লীর মালিক হয়ে উঠেছিলেন। এ-ব্যাপারে সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীটি প্রণিধানযোগ্য।
বইটি থেকে জানা যায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতার একটি এলাকাতেই প্রায় তেতাল্লিশটি বেশ্যালয়ের মালিক ছিলেন। এই অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কী এমন প্রয়োজন পড়ল দ্বারকানাথের, যার জন্য তাঁকে হয়ে উঠতে হল কিছু এতগুলি বেশ্যালয়ের মালিক? এমনকি বলতে গেলে তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হল সোনাগাছির মতো যৌনপল্লী।
এই প্রশ্নের উত্তরও লুকিয়ে আছে দ্বারকানাথের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তৃতির মধ্যে। ইংরেজদের সঙ্গে রীতিমতো টক্কর দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের সূত্রেই কলকাতায় আগমন হয় প্রচুর রাজকর্মচারীর। তাঁরা বেশিরভাগই ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিচুতলার কর্মী এবং বেশিরভাগই অবিবাহিত। ফলে এই ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদের আপ্যায়নের জন্যই দ্বারকানাথ প্রায় তেতাল্লিশটি বেশ্যালয়ের মালিক হয়ে বসলেন। বেশিরভাগ কোঠাতেই ইংরেজ কর্মচারীরা তাদের আমোদ-স্ফূর্তির জন্য রাখতেন এক বা একাধিক নেটিভ উপপত্নী।
এই নেটিভ উপপত্নীরা বিবেচিত হতেন ইংরেজ কর্মচারীদের আনন্দের ‘উপকরণ’ হিসেবে। তবে শুধুমাত্র ইংরেজ কর্মচারীরাই নন, তৎকালীন সময়ে অনেক বাঙালি ‘বাবু’-র মুক্তাঞ্চলও হয়ে ওঠে এইসব যৌনপল্লী, যার মধ্যে অন্যতম ছিল সোনাগাছি।
৪৩টি বেশ্যালয়ের মালিকানা গ্রহণ বা সোনাগাছির মতো যৌনপল্লীর শুরুয়াত হয় দ্বারকানাথের হাত ধরেই। একে দ্বারকানাথের তুখোড় বাণিজ্যিক বুদ্ধির প্রয়োগ বলে গণ্য করা চলে। বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি যেমন ইংরেজ কর্মচারী এবং বাঙালি বাবুদের কাছে আনন্দের অন্যতম উৎস ছিল, তেমনই তার অন্য একটি ধারা হয়তো প্রবাহমান ছিল এই যৌনপল্লীর হাত ধরেই। এভাবেই হাজারো আলোর মধ্যে ঠাকুর পরিবারের অনেক ঘটনাই হয়তো আমাদের অজ্ঞাতই রয়ে গেছে।
এসডব্লিউএসএস/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ