মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) গত ১০ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সংঘাত ঘটেছে ৬ হাজার ১২৬টি। এসব সংঘাতে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪০০ জন। এ ছাড়া আহত হয়েছে ৮৩ হাজার ১৭ জন। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের ৩৯২ জন ও বিএনপি’র ৮৪ জন নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে।
এই দুই রাজনৈতিক দল ছাড়াও অন্য দলের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মৃত্যুও রয়েছে। এ ছাড়া ৩১৩ জন সাধারণ মানুষও নিহত হয়েছেন এই ১০ বছরে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও নিজস্ব সোর্সে সংগৃহীত তথ্যের আলোকে প্রতিবছর হালনাগাদ প্রকাশ করে মানবাধিকার সংস্থাটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ এগিয়ে না নিয়ে বুর্জুয়া ধারায় রাজনীতি হচ্ছে। এতে করে সংঘাত হচ্ছে এবং মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। দেশে যথার্থ নির্বাচন হবে, নির্বাচনের মধ্যে ক্ষমতা পরিবর্তন হবে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। সমঝোতাহীন ও বুর্জুয়া রাজনীতির অংশই হচ্ছে এই সংঘাত।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গণমাধ্যমকেকে বলেন, আমাদের দেশে যে রাজনীতি হয় তা আমরা বুর্জুয়া রাজনীতি বলি। এই রাজনীতি হলো ক্ষমতার জন্য। রাজনীতির দুটো ধারা আছে। একটা হলো বুর্জুয়াদের ধারা; যারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। আরেকটা ধারা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু এটি বাংলাদেশের প্রধান রাজনীতি হয়ে উঠতে পারে নাই। সেই কারণেই রাজনৈতিক সংঘাতে এত মানুষের মৃত্যু হয়।
রাজনৈতিক দলগুলো সব বুর্জুয়া দল। এরসঙ্গে রাষ্ট্র, পুলিশ জড়িত। এই রাষ্ট্র বুর্জুয়ারা শাসন করে। যদিও আমরা এদের বুর্জুয়া বলি কিন্তু তা নামে বুর্জুয়া চরিত্রে বুর্জুয়া নয়। এই অর্থে যে, বুর্জুয়াদের মধ্যে সহিষ্ণুতার একটা গুণ থাকে। সেখানে সংসদীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠার একটা গুণ থাকে। কিন্তু এখন বুর্জুয়াদের সহনশীলতা নেই, এক দল আরেক দলকে সহ্য করতে পারে না। এবং সংসদীয় রাজনীতির ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পায় নাই। কারণ সংসদীয় রাজনীতির মধ্যে সহনশীলতা থাকে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, রাজনৈতিক এই সংঘাতের দায় রাষ্ট্রের। প্রত্যেকটা নাগরিকের জীবন ও অধিকার রক্ষা করা উচিত রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার হয় যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের দ্বারা। পুলিশ এই ভূমিকা নেয়। রাজনৈতিক কারণে পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে পারে না। যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের পক্ষে থাকে পুলিশ। যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে তারা রাজনৈতিকভাবে পুলিশকে ব্যবহার করে।
আসকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই এক দশকে রাজনৈতিক সংঘাতে সবচেয়ে বেশি নিহত ও আহতের ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘাতে। আলোচ্য সময়ে এই সংঘাতে ৯৫১ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৫১ হাজার ১০৪ জন।
মানবাধিকারকর্মী ও আসকের নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, রাজনৈতিক সংঘাতে মৃত্যুর দায় প্রথম তো সরকারের। এ ছাড়া বিবদমান রাজনৈতিক দল আর সমঝোতাহীন রাজনৈতিক কালচারও দায়ী। সমঝোতাহীন রাজনীতি যখন চালু থাকে এবং গণতন্ত্র যখন সংকুচিত হয় তখন বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে।
সেক্ষেত্রে মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা বাড়ে। এই সংঘাত কমাতে সর্বদলীয় আলোচনা ও সমাঝোতার পথ খুঁজে বের করতে হবে। এবং গণতন্ত্রকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া। এটা সব দলের দায়িত্ব এবং সরকারের দায়িত্ব বেশি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার গণমাধ্যমকেকে বলেন, এই রাজনৈতিক সংঘাতের দায় রাজনীতিবিদদের। কারণ রাজনীতি একটা মহান ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা। মানুষের কল্যাণ করার পেশা এটি। কিন্তু এই পেশার সঙ্গে যুক্ত যারা তারা যদি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয় এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।
আমাদের হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি এবং নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতির ফলে মানুষের কল্যাণের বদলে অকল্যাণই হচ্ছে। এর থেকে আমাদের মুক্তি পাওয়া দরকার। আমাদের রাজনীতির ক্ষেত্রে সমঝোতা হওয়া দরকার। তাহলে আমরা এর থেকে উত্তরণ করতে পারবো। আমি মনে করি তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।
এসডব্লিউএসএস/১২২০
আপনার মতামত জানানঃ