কক্সবাজারের টেকনাফে খালে মাছ ধরতে যাওয়া আট বাংলাদেশিকে অপহরণ করেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ভুক্তভোগীদের স্বজনরা জানিয়েছেন, অপহরণের পর মুঠোফোনে কল করে মুক্তিপণ হিসেবে তাদের কাছে তিন লাখ টাকা করে দাবি করা হচ্ছে।
সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) বেলা ১১টায় টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল হালিম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
অপহণের শিকার আট জন হলেন—টেকনাফের উপকূলীয় বাহারছড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা রশিদ আহমদের ছেলে মোহাম্মদ উল্লাহ, ছৈয়দ আমিরের ছেলে মোস্তফা কামাল, তার ভাই করিম উল্লাহ, মমতাজ মিয়ার ছেলে মো রিদুয়ান, রুস্তম আলীর ছেলে সলিম উল্লাহ, কাদের হোসেন ছেলে নুরুল হক, রশিদ আহমদের ছেলে নুরুল আবছার ও নুরুল হকের ছেলে নুর মোহাম্মদ।
ভুক্তভোগীদের স্বজনদের বরাত দিয়ে ওসি হালিম জানান, রবিবার (১৮ ডিসেম্বর) বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা পাহাড়ের বনিরছড়া খালে মাছ শিকারে যান আট জন। সেখান থেকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তাদের ধরে নিয়ে গেছে। অস্ত্রের মুখে মুখোশধারী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তাদের জিম্মি করে পাহাড়ের দিকে নিয়ে যায়।
মোস্তফা ও করিম নামে দুই ভাই অপহৃত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন তাদের বড় ভাই হাবিব উল্লাহ। তিনি জানান, পাহাড়ের ছড়ার খালে মাছ ধরার সময় হঠাৎ করে পাহাড় থেকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা নেমে এসে তাদের জিম্মি করে। পরে তাদের অপহরণ করে পাহাড়ের ভেতরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মুঠোফোনে জানান মোস্তফা। এরপর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ। পরে ভিন্ন ভিন্ন নম্বর থেকে কল করে মুক্তিপণ হিসেবে তিন লাখ টাকা দাবি করছে।
অপহরণের শিকার মো. রিদুয়ানের বাবা মমতাজ জানান, মোস্তফা কামালসহ আটজন পাহাড়ি এলাকার খালে মাছ ধরতে গেলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের নিয়ে যায়। স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পাওয়ার পর মেম্বার ও চেয়ারম্যানসহ থানায় জানানো হয়। এখন পর্যন্ত তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
তবে রাত সাড়ে ৯টার দিকে অপহরণকারীরা ফোন করে জনপ্রতি তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন বলে জানান মো. রিদুয়ানের বাবা মমতাজ।
বাহারছড়ার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীসহ আটজনকে অপহরণ করে অস্ত্রধারী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এ এলাকাগুলো দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। কাউকে একা পেলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা অপহরণ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনায় এলাকাবাসী আতঙ্কে আছে।
বাহারছড়ার ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হুমায়ুন কাদের বলেন, ‘আট জনের কাউকে এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মাছ শিকার করতে গিয়ে তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত ফেরত না আসার বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের অবহিত করেছে পরিবারগুলো।’
এ বিষয়ে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মশিউর রহমান বলেন, ‘খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেছে। তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। পরে বিস্তারিত জানানো হবে।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা সমস্যা নতুন কিছু নয়, তবে এই সমস্যা এখন স্থানীয়দের জন্য বহুমাত্রিক হুমকিতে পরিণতি হয়েছে। বিশেষ করে নতুন করে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আশ্রয় দেওয়ার পর থেকে স্থানীয়দের সমস্যা বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ব্র্যাকের এক গবেষণায় স্থানীয় পাঁচ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন যে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া ঠিক হয়নি, বাতি ৯৫ শতাংশই মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের পাশে থাকার পক্ষে ছিলেন।
কিন্তু ২০১৯ সালের এপ্রিলের জরিপে দেখা যায়, যারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে ছিলেন তারাই বিপক্ষে চলে গেছেন। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন ৮০ শতাংশ মানুষ। এই জরিপের ফলাফলেই বোঝা যায় যে, স্থানীয়রা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন রোহিঙ্গাদের কারণে। জীবন-জীবিকা নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছেন স্থানীয়রা।
কয়েক দফায় এখন পর্যন্ত কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার মোট সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এসব রোহিঙ্গার কারণে বিশেষ করে উখিয়া ও টেকনাফের পাঁচ থেকে ছয় লাখ মানুষ বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে জানা গেছে।
ইউএনডিপির এক গবেষণায় দেখা যায়, কক্সবাজারের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বলেছেন তারা রোহিঙ্গাদের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জরিপে অংশ নেওয়া টেকনাফের শতভাগ এবং উখিয়ার ৮০ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত।
স্থানীয় কৃষক ও জেলেরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের অনেকের অপরাধ প্রবণতায় স্থানীয়রা বিরক্ত হয়ে উঠেছে। তাদের কারণে কৃষিকাজ, মাছ ধরা ও শ্রম বাজার এক প্রকার বন্ধ। এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার অবস্থানের কারণে কিছু লোক ছাড়া বেশিরভাগ স্থানীয় বাসিন্দাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রোহিঙ্গা ঢল শুরু হওয়ার আগে টেকনাফের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজ, লবণ চাষ কিংবা মাছ ধরার কাজে জড়িত ছিলেন। কিন্তু এখন সেসব কাজ নেই বললেই চলে।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিয়মতি যাতায়াত রয়েছে স্থানীয় সাংবাদিক নুরুল হকের। কাজের সূত্রে স্থানীয়দের সঙ্গে বেশ যোগাযোগ হয় তার। তিনি বলেন, ‘আগে মানুষ যে মানবিক দিক দেখাতো, তা পরিবর্তন হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের কালচার, চলাফেরা- এসব নিয়ে অনেকে আপত্তি করছেন। স্থানীয় মানুষের অর্থ উপার্জন কমে গেছে। রোহিঙ্গাদের কারণে নিরাপদে চলাফেরাও কঠিন হয়েছে।’
এই সাংবাদিক বলেন, ‘স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা, রোহিঙ্গারা তাদের চেয়ে সুখে আছে। এই আরাম ছেড়ে তারা আবার মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে যেতে চাইবে না।’
এসডব্লিউএসএস/১৮১০
আপনার মতামত জানানঃ