কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নজিরবিহীন বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, যা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। মধ্যবিত্ত মানুষ নেমে এসেছে নিম্নবিত্তে। যার ফলে মানুষ তাদের সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। ব্যাংক আমানত হারিয়েছে। একই সাথে ঋণ খেলাপির সংখ্যা বেড়েছে। এমনটাই বলে আসছে সরকার। এটাই ভেবে নিয়েছে দেশের সাধারণ নাগরিকও। তবে এবার সরকারের গোমর ফাঁস হল। ব্যাংক ব্যবস্থার আজকের পরিণতির জন্য করোনা মহামারি দায়ী নয়।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতার সঙ্গে কোভিড-১৯ মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই দুর্বলতার মুখোমুখি রয়েছে।
সিপিডি আরও বলেছে, ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এই খাতের সব সূচকেই রয়েছে দুর্বলতা। সুশাসন ও সংস্কারের অভাবে পুরো খাতটি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় লক্ষ্য ও সময়ভিত্তিক, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠন করা জরুরি।
গতকাল শনিবার ঢাকার মহাখালীর ব্র্যাক-ইন সেন্টারে সিপিডি আয়োজিত ‘সংকটে অর্থনীতি: কর্মপরিকল্পনা কী হতে পারে?’ শীর্ষক সংলাপে এসব কথা ওঠে আসে। এতে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সংলাপে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রধান অতিথি এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহানের সঞ্চালনায় সংলাপে আলোচকদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রূপালী চৌধুরী।
মূল প্রবন্ধে ফাহমিদা খাতুন বলেন, খেলাপি ঋণ এখন কত, তা সবার মুখস্থ (১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা)। এ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যাংকগুলোতে মূলধনের ঘাটতি থেকেই যাবে। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ যা দেখানো হয়, বাস্তবে তা আরও বেশি। অর্থনীতিবিদেরা এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) এ কথা বলে থাকে।
প্রাতিষ্ঠানিক, প্রশাসনিক, আইনগত ও তথ্যগত—এ চার সমস্যা ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করেছে সিপিডি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এখানে ভুল নীতি প্রণীত হচ্ছে। হোটেলে বসে মুদ্রানীতির প্রধান চলকগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। অদ্ভুত! আগে কোনো দিন এ রকম ঘটনা শুনিনি।’
মার্কিন ডলারের চার রকমের দর নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। বলেন, নগদ জমার হার (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) মাফ করে দেওয়ার ঘটনাও এখন ব্যাংক খাতে দেখা যাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থনীতিতে কী ঘটেছে, বিভিন্ন ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেহেতু বাড়ছিল, সেহেতু এর ব্যবস্থাপনাটা দেখার দায়িত্বের কথাও এসে যায়। মূল্যস্ফীতি যখন বাড়তে থাকল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন কী করল?
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘যে মুদ্রানীতির কথা আমরা শুনেছিলাম, তাতে সংকোচনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তথ্য-উপাত্তে তা আর দেখা যায়নি।’
পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সমস্যা নীতি প্রণয়নে। ভারতের মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। তারপরও তারা সুদের হার বাড়িয়েছে। সরকার বলছে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সংকট কেটে যাবে। আমি বিশ্বাস করি না।’
ব্যাংক খাতের সাম্প্রতিক প্রবণতা নিয়ে আহসান মনসুর বলেন, ‘খারাপ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে মানুষ ভালো ব্যাংকে রাখছে। দেখলাম যে ব্র্যাক ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি ৩৪ শতাংশ। এত প্রবৃদ্ধি আমরা আশাই করিনি।’
এসডব্লিউএসএস০৮৪৫
আপনার মতামত জানানঃ