২০১৮-১৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অধীন উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা এক ধাক্কায় ২৩৬টি বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৭৬টিতে। একই সঙ্গে ব্যয়ও প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৬ কোটি টাকায়। উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয়ের এ প্রবণতা বজায় ছিল পরের দুই অর্থবছরেও। এখন পর্যন্ত এডিপির অধীনে এ তিন অর্থবছরেই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরেও উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারের বরাদ্দ ঠেকেছে ২ লাখ ১২ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকায়। পর্যাপ্ত রাজস্ব আয় না বাড়িয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধির এ প্রবণতা দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টির পেছনে বড় অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে কিনা, সে বিষয়ে এখন প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতিবিদরা।
গত এক দশকে দেশে ব্যাপক মাত্রায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় দেশে একের পর এক ছোট থেকে শুরু করে মেগা অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে এডিপির অধীন উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যায় বড় উল্লম্ফন ঘটে। ওই অর্থবছর প্রকল্প সংখ্যা প্রথমবারের মতো ১ হাজার ৯০০ ছাড়িয়ে যায়, যা বজায় ছিল ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত।
ওই তিন অর্থবছরে বিপুল পরিমাণ প্রকল্প অনুমোদন এবং এ বাবদ ব্যয় বৃদ্ধিই দেশের বর্তমান আর্থিক সংকটকে ঘনীভূত করেছে কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ সময় নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে মানেই সরকারি ব্যয় ও কেনাকাটা বেড়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে আমদানি চাপও। সব মিলিয়ে এ তিন অর্থবছরে সরকারের ব্যয়ের ওপর বড় ধরনের চাপ পড়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে এডিপির অধীন প্রকল্প ছিল ১ হাজার ১৮৩টি। ওই অর্থবছরে প্রকল্পগুলোর পেছনে সরকারের ব্যয় হয় ২৫ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় প্রতি অর্থবছরেই প্রকল্পের সংখ্যা ও ব্যয় দুটিই বেড়েছে। এডিপির অধীনে সবচেয়ে বেশি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন ছিল ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত তিন অর্থবছরে। এর মধ্যে ব্যয়ের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। এ সময় ১ হাজার ৯৫৪টি প্রকল্পের বিপরীতে মোট ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৬ কোটি (প্রকল্প সংখ্যা ১ হাজার ৯৭৬) ও ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা (প্রকল্প সংখ্যা ১ হাজার ৯০৮)।
এছাড়া প্রকল্প ব্যয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন দেখা যায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। ওই সময়ে এক অর্থবছরেই ৪১ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয় উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয়। আর প্রকল্প সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করা হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। ওই বছর এক লাফে এডিপির অধীন উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা বেড়ে যায় ২৩৬টি।
আলোচিত সময়ে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, কয়লাভিত্তিক বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে শুরু করে দেশের ছোটখাটো নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতিও আমদানি করতে হয়েছে। আবার রড, সিমেন্ট, পাথরের মতো অবকাঠামো নির্মাণ উপকরণ দেশে উৎপাদন হলেও এগুলোর কাঁচামাল আনতে হয়েছে বিদেশ থেকে। উন্নয়ন প্রকল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি, নির্মাণ উপকরণ আমদানি থেকে শুরু করে বিদেশী শ্রমিকের পারিশ্রমিক পরিশোধে ব্যয় হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা। রেমিট্যান্স, রফতানি আয় ও বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণের চেয়েও ডলারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টে (বিওপি) বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আবার অনেক বড় প্রকল্প আর্থিকভাবে লাভজনক না হওয়ারও নজির রয়েছে।
বেসরকারি খাতের অস্বাভাবিক আমদানির চাপ, অর্থ পাচারের পাশাপাশি সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পদ্মা সেতু দিয়ে রেল সংযোগে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এ টাকা খরচ করে পায়রা বন্দর ও যশোর পর্যন্ত যে রেললাইন নেয়া হচ্ছে, সেটি লাভজনক না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তেমনিভাবে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার নির্মীয়মান রেললাইন প্রকল্পও লাভজনকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। একইভাবে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের মুনাফাযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এটি থেকেও খুব বেশি মানুষের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এ ধরনের প্রকল্পগুলোকে ‘শ্বেতহস্তী’ আখ্যা দিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, অনেকগুলো প্রকল্প নেয়া হয়েছে, যেগুলোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। নীতিনির্ধারক পর্যায়ের খামখেয়ালিপনার কারণে সেগুলো গ্রহণ করা হয়েছে। এখন যে ডলার সংকট, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, আমদানি-রফতানির মধ্যে বিশাল পার্থক্য সৃষ্টি হওয়ার মতো সমস্যা তৈরি হয়েছে; এগুলো আগামী বছরগুলোয় যদি ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। এক বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলার কমেছে। ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সেখান থেকে কমে এখন ২৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছে। এক বছরে ২২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের পতন, এটি বড় ধরনের একটা বিপদ; যা এরই মধ্যে ঘটে গিয়েছে। এ ধারা বন্ধ করতে না পারলে আগামী এক বছরে সাংঘাতিক সংকটে পড়ে যাবে অর্থনীতি।
সরকারের মেগা প্রকল্প বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের মোট ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ ছিল ৫৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে আমদানির নতুন এলসি খোলা কিছুটা কমে যায়। এর পরও অর্থবছরটিতে ৫৩ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের নতুন এলসি খোলা হয়েছিল। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আমদানির এলসি খোলা হয়েছে গত দুই অর্থবছরে। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ ৬৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। আর সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানির নতুন এলসি খোলার পরিমাণ দাঁড়ায় ৯২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। ইতিহাস সৃষ্টি করা আমদানির নতুন এ এলসিই দেশের অর্থনীতির বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে।
আমরা পাব। সারা দেশেই উন্নয়ন প্রকল্প ছড়িয়ে গিয়েছে। এগুলোর ফল অবশ্যই আসবে। বিশ্লেষণ করলে অনেক কিছুই বলা যাবে। কিন্তু সার্বিক ফলটা দেখতে হবে। আমরা যারা সরকারে আছি, তারা গোটা ফল দেখি। মাথাপিছু আয় দেখি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখি। ঋণ-জিডিপি অনুপাত দেখি। এ সবকিছু দেখেই আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া যেতে পারে। সেগুলো আমরা নিজেরাও বিবেচনা করি। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা বড় প্রকল্প কম নিচ্ছি। সরকারপ্রধান বলেছেন এখন আপাতত বড় প্রকল্পের দিকে না যেতে। আমার বিশ্বাস, আগামী চার-পাঁচ মাস কৃচ্ছ্রতার মধ্যে থাকলে বর্তমান সংকট আমরা পার হতে পারব।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ