২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে ন্যক্কারজনক হামলার ১০ বছর পূর্ণ হলো আজ। কিন্তু সেই ঘটনার বিচার হয়নি।
সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে ১৮টি মামলা। আর যার ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ নিয়ে ওই ট্র্যাজেডি সংঘটিত হয়, উত্তম বড়ুয়া নামের সেই বৌদ্ধ যুবকের সন্ধান মেলেনি আজও।
তবে তার মা মাধু বড়ুয়ার ধারনা, উত্তম বেঁচে আছে। পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে অর্থকষ্টে চরম দুরাবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন বলে জানালেন উত্তমের বাবা সুদত্ত বড়ুয়া।
অন্যদিকে ১০ বছরে একটি মামলারও বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশ বৌদ্ধ সম্প্রদায়।
একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন উত্তমের স্ত্রী রিতা বড়ুয়া। এদিকে বিচার শুরু হয়নি সেই সময়ে করা ১৮টি মামলারও। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন ‘নতুন বিপদের’ শঙ্কায় কারও বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে চান না।
রামুর ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের হাইটুপী গ্রামে উত্তমের বাড়ি। বিয়ের পর থেকে স্ত্রীকে নিয়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মেরংলোয়া গ্রামে ভাড়া বাসায় আলাদা সংসার পাতেন উত্তম।
উত্তম কোথায় জানতে চাইলে উত্তমের স্ত্রী রিতা বড়ুয়া সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘জানি না। সম্ভবত বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে এত দিনে যোগাযোগ হতো। অন্তত একবার হলেও ছেলের খোঁজ নিত।’
উত্তম যখন বাড়ি থেকে পালিয়ে যান, তখন তার একমাত্র ছেলের বয়স ছিল আড়াই বছর। রিতা বড়ুয়া বলেন, ‘ছেলেটা বড় হচ্ছে, বারবার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু কিছুই বলতে পারি না।’
রিতা বড়ুয়া অভিযোগ করে বলেন, উত্তমের কারণে তিনি সবার রোষানলে পড়েন। জীবিকার জন্য চাকরিও পাওয়া যায় না। এখন কিছু ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে যা আয় হচ্ছে, তা দিয়ে চলছে টানাপোড়েনের সংসার।
হাইটুপী গ্রামে ছোট্ট টিনের ঘরে প্রতিবন্ধী এক মেয়েকে নিয়ে থাকেন উত্তম বড়ুয়ার বৃদ্ধ মা মাধু বড়ুয়া (৫৪)। ছেলের প্রসঙ্গ তুলতেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘উত্তমের জন্য মন জ্বলে, কিন্তু খুঁজে পাই না।’
ছেলেটা বড় হচ্ছে, বারবার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু কিছুই বলতে পারি না।
পুলিশ ও আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে উত্তম কুমার বড়ুয়া নামের এক ব্যক্তির ফেসবুক পেজে কথিত কোরআন অবমাননার কয়েকটি ছবি প্রকাশ করা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মধ্যরাতে দুর্বৃত্তরা হামলা ও অগ্নিসংযোগ চালিয়ে ধ্বংস করে রামুর ১২টি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধদের ৩৪টি বসতবাড়ি। পরের দিন অগ্নিসংযোগ করা হয় উখিয়া ও টেকনাফের আরও সাতটি বৌদ্ধবিহার ও হিন্দুমন্দিরে। এ ঘটনার মামলাগুলো কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। মামলার ৯৯৫ জন আসামি জামিনে রয়েছেন।
রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি) মো. আনোয়ারুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর মামলার প্রধান আসামি উত্তম কুমার বড়ুয়া। ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক। কোথায় আছে পুলিশের জানা নেই।
মামলার অগ্রগতি ও আসামিদের অবস্থান
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে কক্সবাজারের রামুতে প্রতিবাদ মিছিল, মিটিং শুরু হয়। অভিযোগ, উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুক প্রফাইলে কোরআন অবমাননা করা হয়েছে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে উত্তজনা বাড়তে থাকে রামুর বৌদ্ধপল্লীগুলোতে। পরে ঘটনা আর শুধু উত্তেজনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।
মিছিল মিটিং, ভাংচুর লুটপাট চালিয়ে ওইদিন পৌনে ১২টার দিকে প্রথম অগ্নিসংযোগ করা হয় ফতেখাঁরকুলের শ্রীকুল গ্রামে অবস্থিত কয়েকশ’ বছরের পুরনো বৌদ্ধ পুরাকীর্তি লালচিং-এ। এরপর সাদাচিং, মৈত্রী বিহার, অপর্ণাচরণ বৌদ্ধ বিহার, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার, জাদীপাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহার, উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বন বিহার, বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রসহ ১২টি বৌদ্ধ বিহারে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় রামু সীমা বিহার সংলগ্ন ২৬টি বসত ঘর। একই অভিযোগে পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়ার বিভিন্ন বৌদ্ধমন্দিরে একই ধরনের হামলা হয়।
ওই সাম্প্রদায়িক হামলার ১০ বছরে রামুতে বৌদ্ধ-মুসলিম সম্প্রদায়ে সম্প্রীতি ফিরলেও মুছে যায়নি মনের ক্ষত। ওই দিনের হামলার ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা করা হয়েছিল। এতে এজাহারভুক্ত ৩৭৫ জনসহ ১৫ হাজার ১৮২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এরপর আপসের ভিত্তিতে একটি মামলা প্রত্যাহার করা হলেও ১৮টি মামলায় ৯৯৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় তদন্তকারী সংস্থা। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে আটকে গেছে মামলার বিচারকাজ।
জানা গেছে, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন বৌদ্ধমন্দির ও ঘরবাড়িতে হামলা এবং অগ্নিসংযোগের বেশ কিছু ছবি-ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা থাকলেও অভিযোগপত্রে অনেকের নাম বাদ পড়েছে। রামু বৌদ্ধমন্দিরে হামলার ঘটনায় করা মামলার মূল অভিযুক্তদের বেশির ভাগ মানুষ জামিনে, কেউ কেউ ধরাছোঁয়ার বাইরে বেরিয়ে গেছেন। এই সাম্প্রদায়িক হামলার মূল অভিযুক্ত রামু ফকিরা বাজারের ফারুক কম্পিউটারের ফারুক ও আলিফ মুক্তাদিলও জামিনে রয়েছেন।
শুধু তাই নয়, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর যে বৌদ্ধ তরুণ উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুক আইডির মাধ্যমে কোরআন অবমাননার ছবি ছড়ানোর গুজব রটেছিল, আজ অবধি নিখোঁজ রয়েছেন তিনি। গত ১০ বছর ধরে উত্তম বড়ুয়ার কোনো খোঁজ পায়নি সরকারি-বেসরকারি সংস্থা।
প্রতিবছর ২৯ সেপ্টেম্বরের বিভীষিকাময় কালো রাতকে স্মরণ করতে স্থানীয় বিভিন্ন বৌদ্ধ সংগঠন আয়োজন করে সংঘদান ও শান্তি শোভাযাত্রার। প্রতিবছর এই দিনে বিচারের দাবিতে স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন জড়ো হন।
কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, আলোচিত এ হামলার ঘটনায় এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, গত ১০ বছরে তা অনেকটা ঘুচে গেছে।
তিনি বলেন, ঘটনার পর পর সরকার ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ বিহার ও বাড়ি ঘরগুলো পুণঃনির্মান করে দিয়েছে। বিশেষ করে পুনর্বাসনের দিকটায় সরকারের কোনো অবহেলা ছিল না। তবে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম অসন্তোষ রয়েছে।
এ ধরনের ঘটনার যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয় এবং এক রাতে পুড়ে যাওয়া হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধারে সবাইকে কাজ করার আহবান জানান এই বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশটিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা এমনিতেই নানা রকম আতঙ্ক ও নির্যাতনে থাকেন। সব সময় সতর্ক থাকেন যেন পান থেকে কোনো কারণে একটুও চুন খসে না পড়ে। কেননা, একটু চুন খসে পড়ার খেসারত কী হতে পারে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সকলেরই রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যখন নিজ দেশের আইনও তাদের পাশে না দাঁড়ায়, তখন তারা আরও অসহায় হয়ে পড়েন। দেশে ধর্মীয় ইস্যুতে ঘটা ঘটনায় আইনের এইযে বৈষম্য, তা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রত্যক্ষ কারণ।
তারা বলেন, সরকার ও প্রশাসন সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের মানুষের কথা যত দ্রুত আমলে নেন, ততই ধীর হয় সংখ্যালঘুদের বিষয়ে। কেননা এতে ভোটের রাজনীতি জড়িত। দেশে ভোটের এই রাজনীতির কারণেই অধিকাংশ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়ে থাকে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০১
আপনার মতামত জানানঃ