রাজতন্ত্র আজ সারা বিশ্বের সামনে ব্রিটেনের অন্যতম প্রধান প্রতীক। হাজার বছরের ইতিহাসের জন্য ব্রিটেনকে এখন রাজতন্ত্র ছাড়া কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু সতেরশো শতকে এমনও এক সময় ছিল যখন ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। সেটি ছিল রাজা প্রথম ও দ্বিতীয় চার্লসের শাসনের মাঝখানের এক দশক। কাকতালীয়ভাবে, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস এখন রাজা হয়ে তৃতীয় চার্লস নাম গ্রহণ করেছেন।
ইংল্যান্ডে ১৬৪০ এর দশকে রাজা প্রথম চার্লস এবং পার্লামেন্টের মধ্যে বাধে বিরোধ, যার পরিণামে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সেই পরিস্থিতিতে তিনটি ভিন্ন সঙ্কট একই সঙ্গে দেখা গিয়েছিল বলে জানান ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ব্লেয়ার ওয়ার্ডেন।
ব্লেয়ার ওয়ার্ডেন লিখেছেন, একটি ছিল সাংবিধানিক সঙ্কট। রাজা প্রথম চার্লস ফ্রান্স এবং স্পেনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রাজাদের স্টাইলে শক্তিশালী হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল এমন এক সময়ে যখন তার অবস্থান ছিল খুবই দুর্বল। রাজকার্য চালানোর জন্য তার কাছে পর্যাপ্ত অর্থও ছিল না। অর্থের জন্য তিনি নির্ভর করতেন জমিদারদের আয়ের ওপর। কিন্তু তাদের দেওয়া অর্থের পরিমাণ বাড়ছিল না।
ওদিকে, ইংল্যান্ডে তখন মূল্যস্ফীতিও দ্রুত বাড়ছিল, কারণ আমলাতন্ত্রের কাঠামো বাড়ছিল, ফলে তাদের পেছনে ব্যয়ও বাড়ছিল। তিনি বলেন, তহবিল সংগ্রহের জন্য রাজাকে নির্ভর করতে হতো আইনসভার ওপর এবং আইনসভা যখন অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে অস্বীকার করলো তখন সংসদকে পাশ কাটিয়ে রাজা কর বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এর ফলে তৈরি হয়েছিল এক সাংবিধানিক সঙ্কট।
একই সময়ে, স্কটল্যান্ডের ক্যাথলিক গির্জার ওপর অ্যাংলিকান প্রটেস্টান্ট রীতিনীতি চাপিয়ে দেয়ার প্রশ্নে রাজা প্রথম চার্লস জেদ ধরেছিলেন। ফলে দেখা দেয় একটি ধর্মীয় সঙ্কট। স্কটল্যান্ডের অধিবাসীরা এটার বিরুদ্ধে এমন প্রতিরোধ তৈরি করেছিল যে পরে শুরু হয়েছিল তথাকথিত “বিশপদের যুদ্ধ।”
তৃতীয়টি ছিল একটি ব্রিটিশ সঙ্কট। কারণ, ইংল্যান্ডের রাজারা একই সাথে স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডেরও শাসক ছিলেন। ১৭শ শতকের শুরুতে ইংরেজরা আয়ারল্যান্ডে জমির মালিকানা পাচ্ছিলেন। এর ফলে তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজন বিদ্রোহ করতে শুরু করে। ফলে, সব মিলিয়ে ১৬৪০ সালের দিকে এসব রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সঙ্কট ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের মধ্যে সঙ্কটের সাথে যুক্ত হয়।
রাজা প্রথম চার্লসের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের বিজয়ের সঙ্গে সেই গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছিল। কিন্তু পরে যা ঘটেছিল তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। ব্লেয়ার ওয়ার্ডেন জানান, যুদ্ধে জয়লাভের জন্য পার্লামেন্টকে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে হয়েছিল যেটি পরে খুব উগ্র ও বিপ্লবী হয়ে উঠেছিল। সেই বাহিনীর চাপের মুখে ১৬৪৯ সালে রাজাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং রাজতন্ত্র বিলোপ করা হয়। পার্লামেন্টে অভিজাতদের হাউজ অব লর্ডসও বিলুপ্ত হয়।
রাজা প্রথম চার্লসের শিরশ্ছেদের আগেও অন্য একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছিল: রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তার বিচার এবং রায়ে তার মৃত্যুদণ্ড। অধ্যাপক ওয়ার্ডেন বলেন, এটি ছিল খুবই নতুন এক ধারণা। সাধারণত, মানুষ রাজা বা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করলে রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য তার বিচার করা হয়। কিন্তু তখনকার নেতারা একটি নতুন মতবাদ তৈরি করছিলেন। তা হল: রাজা প্রথম চার্লসই তার প্রজাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।
এই মতবাদটি যাতে উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে অলিভার ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয় পার্লামেন্টে শুদ্ধি অভিযান চালাতে। যেসব সংসদ সদস্য এই বিচার এবং রাজাকে দোষী সাব্যস্ত করার প্রক্রিয়ার সাথে একমত হননি তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করা হয়েছিল।
রাজতন্ত্রের বিলুপ্তির পর ‘কমনওয়েলথ অব ইংল্যান্ড’ নতুন একটি সরকার গঠন করা হয়। ইতিহাসবিদ অ্যানা কিয়ে সম্প্রতি একটি বই প্রকাশ করেছেন। তার নাম “দ্য রেস্টলেস রিপাবলিক: ব্রিটেন উইদাউট আ ক্রাউন।”
তিনি বলেছেন, এটি ছিল মূলত যাকে এখন আমরা প্রজাতন্ত্র নামে জানি। সেখানে ছিল একটি কাউন্সিল অব স্টেট, যেটি সংসদ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হতো। ঘুরে ঘুরে এর প্রধান নিযুক্ত হতো এবং এই কাউন্সিল নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করতো। এই সরকারের সময় রাজকীয় প্রাসাদগুলো বিক্রি করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। শুধু কয়েকটি প্রাসাদ কাউন্সিল অফ স্টেটের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এই শাসন ব্যবস্থায় ইংল্যান্ডের জনগণকে দেশের সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯২৫
আপনার মতামত জানানঃ