সীমান্তে মিয়ানমারের মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা প্রয়োজনে জাতিসংঘকে জানানো হবে, বলেছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন শক্ত বার্তা দিতে না পারায় বাংলাদেশকে পাত্তা দিচ্ছে না মিয়ানমার৷
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায় থেকে এ নিয়ে মিয়ানমারকে বার বার সতর্ক করা হচ্ছে বলে দাবি সরকারের৷ বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সতর্ক করা হয়েছে বলে জানা গেছে৷ কিন্তু তারপরও থামছে না বাংলাদশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের এই অস্থিরতা৷
সাবেক কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমারকে থামাতে প্রয়োজনীয় যে শক্ত বার্তা দেওয়া প্রয়োজন তা পারছে না সরকার৷ আর এ কারণেই বাংলাদেশের বার্তা আমলে নিচ্ছে না মিয়ানমার৷ শক্ত বার্তা প্রদানের অংশ হিসেবে সীমান্তে অবস্থান শক্তিশালী করার পরামর্শ তাদের৷
গত শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেল বিস্ফোরণে ইকবাল নামে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হয়েছেন৷ এ ঘটনায় আরও পাঁচজন আহত হয়েছেন৷ নিহত ইকবাল ও আহতরা তুমব্রু সীমান্তে নো ম্যানস ল্যান্ডের বাসিন্দা৷ রাতে জিরো লাইন থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও শনিবার সকালে তারা আবার জিরো লাইনের আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছেন৷ কিন্তু তারা চরম আতঙ্কের মধ্যে আছেন৷
নিরাপত্তার জন্য সীমান্ত এলাকার ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রটি সরিয়ে ওই কোন্দ্রের ৪৯৯জন পরীক্ষার্থীকে শনিবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং পরীক্ষাকেন্দ্রে নেয়া হয়৷
তার আগে গত ৯ সেপ্টেম্বর বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি বুলেট এসে পড়ে৷ ৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দুটি গোলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকায় পড়ে৷ ২৮ আগস্ট বিকাল ৩টার দিকে মিয়ানমার থেকে নিক্ষেপ করা একটি মর্টার শেল অবিস্ফোরিত অবস্থায় ঘুমধুমের তুমব্রুর উত্তর মসজিদের কাছে পড়ে৷
বর্তমান পরিস্থিতি
ঘুমধুম সীমান্তের তুমব্রু গ্রামের মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘‘আমরা ভয়ের মধ্যে আছি৷ কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে চলেও গেছেন৷ শুক্রবার রাতে মর্টার শেল পড়ার পর আমাদের এলাকার অনেকেই নিরাপদে সরে গিয়েছিলেন৷ সকালে আবার ফিরে এসেছেন৷”
তিনি জানান, ‘‘শনিবারও সীমান্তের ওই পাশে সারাদিন গুলাগুলির শব্দ শোনা গেছে৷ আমাদের প্রয়োজনীয় কোনো কাজ না থাকলে ঘরের বাইরে বের না হওয়ার জন্য বলা হয়েছে৷”
ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা তারেক আজিজ বলেন, ‘‘শনিবার রাতে তুমব্রু নো ম্যানস ল্যান্ডে মর্টার শেল পড়লেও তার সাথেই কোনাপাড়া গ্রাম৷ শুক্রবার রাতেই ওই গ্রামের সবাই তাদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িত চলে গেছেন৷ আমরা এখন কখন কী হয় সেই আতঙ্কে আছি৷”
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান শনিবার জানান, মিয়ানমারের মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা প্রয়োজনে জাতিসংঘকে জানানো হবে৷ তিনি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘মিয়ানমার ইস্যুতে বাংলাদেশ যুদ্ধ চায় না৷ শান্তিপূর্ণ ও কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছে৷”
তিনি জানান, ‘‘বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে বার বার সতর্ক করা হলেও তারা কথা দিয়ে কথা রাখেনি৷ এছাড়াও বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের মর্টার শেল নিক্ষেপ ও হতাহতের ঘটনায় মিয়ানমারকে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানানো হয়েছে৷”
‘নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে হবে’
বাংলাদেশের আকাশ সীমা লঙ্ঘন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বার বার গোলা নিক্ষেপ নিয়মিত ঘটনায় পরিণত করেছে মিয়ানমার৷ প্রতিটি ঘটনায় ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে ‘কড়া প্রতিবাদ’ জানানোর পরও কোনো কাজ হচ্ছে না৷
গত ১৪ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার আর কোনো গোলা ফেলবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷’’
কিন্তু পরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন কথার পরও দেখা গেছে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গোলা বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সীমান্তে পড়েছে৷
মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশ মিয়ানমারকে শক্ত মেসেজ দিতে পারছে না৷ ফলে বাংলাদেশকে তারা পাত্তা দিচ্ছে না৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘সীমান্তে আমাদের এখন অবস্থানটি এমন হতে হবে যাতে তারা বুঝতে পারে যে এসব কিছু করে পার পাওয়া যাবে না৷ সীমান্তে সেই অবস্থানটি আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছিনা৷’’
তার কথা, ‘‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে বললেন, আমরা যুদ্ধ চাই না এটা তো বলার কোনো কথা নয়৷ এতে তো আমাদের দুর্বলতা প্রকাশ পায়৷ আমরা কী চাই সেটা বলতে হবে৷ আমার মনে হয় আমরা বিষয়টি ঠিক মতো অ্যাড্রেস করতে পারছি না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এখন মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে৷ আর আরাকান আর্মিও শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে৷ এটা দীর্ঘস্থায়ী হবে৷ তাই আমাদের বাস্তবে শক্ত অবস্থান নিতে হবে৷”
বিশেষজ্ঞদের মতামত
আর ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশেকে মিয়ানমারের বিষয় নিয়ে কূটনৈতিকভাবেই কাজ করতে হবে৷ কিন্তু মিয়ানমারকে এটাও বোঝাতে হবে যে বাংলাদেশ জবাব দিতে সক্ষম৷ তারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে না সত্য কিন্তু তারা যা করছে তা একরকম যুদ্ধের উসকানি ছাড়া আর কিছু না৷’’
তার কথা, ‘‘বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতায় এখন চীন ও ভারতকে গুরুত্বের মধ্যে নিতে হবে৷ এই দুইটি দেশকে কাজে লাগাতে পারলে মিয়ানমারের অবস্থার পরিবর্তন হবে৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়োজনে বিষয়টি জাতিসংঘে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন৷ কিন্তু এই বলাই যেন শেষ না হয়৷
তার মতে, এটাকে আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে৷ কারণ মিয়ানমার এমন একটি দেশ যেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার বলে কিছু নেই৷ তারা নানা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আছে৷ এই অঞ্চলের নিরপত্তা স্থিতিশীলতার জন্য তারা হুমকি৷
এসডব্লিউ/এসওস/১১২৫
আপনার মতামত জানানঃ