আমরা ভেবেছিলাম ২০০৮ এর নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের অবস্থার পরিবর্তন হবে। তা না হয়ে আরও খারাপ হয়েছে। সরকারের মধ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তি আরও গাঢ় হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরকার সরে যাচ্ছে। আমরা সংখ্যালঘুদের নিয়ে বৈষম্যের অবসান চাই।
সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলা হয়।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বাজেটে দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনা করে তারা বলছে, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য পরিচালন ব্যয় খাতে মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ব্যয় বাদে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জন্য মোট বরাদ্দের হার ৯৭ দশমিক ৮৭ এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য ২ দশমিক ১৩।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্পগুলোর মোট প্রকল্প ব্যয়ের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ ৯৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য রাখেন ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম ২০০৮ সালের পর সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য কমবে। আগে যা বরাদ্দ হতো, এখনো তা আছে। বরং আরও কমছে।’ সরকারের মধ্যে শক্তি বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।
লিখিত বক্তব্যে রাণা দাশগুপ্ত বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট পরিচালন ব্যয়ের পরিমাণ ৩১৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। তার মধ্যে সচিবালয়ে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ব্যয় ১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বাদ দেওয়ার পর ৩০৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকার মধ্যে ২৯৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা দেশের ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সাড়ে ছয় কোটি টাকা। অর্থাৎ ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জন্য মোট বরাদ্দের হার ৯৭ দশমিক ৮৭ এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্যে ২ দশমিক ১৩, যা আগের অর্থবছরে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৯৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্যে মোট বরাদ্দ ছিল ২ দশমিক ২৫ শতাংশ।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্পগুলোর মোট প্রকল্প ব্যয়ের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ ৯৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্পে বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, বর্তমানে এই মন্ত্রণালয়ের অধীন চলমান প্রকল্পগুলোর মোট ব্যয় ৯ হাজার ৯৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা। তার মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ ৯ হাজার ৬১৯ কোটি ১৩ লাখ বা ৯৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ ৩১২ কোটি ৯৫ লাখ বা ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে দেশের সকল সম্প্রদায়ের নৈতিক ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন সময়ের দাবি।
তিনি বলেন, বিগত নির্বাচনের আগে সরকারি দলের দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব প্রতিশ্রুতির মধ্যে আছে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি ও পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন।
সংবাদ সম্মেলনে চার দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো: ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও কল্যাণে জাতীয় রাজস্ব বাজেট থেকে বার্ষিক বরাদ্দ প্রদান করে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টগুলোকে ‘ফাউন্ডেশন’-এ রূপান্তরিত করতে হবে।
সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয় সংবিধানের ২-ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রধর্মের পক্ষে কাজ করছে। এ অনুচ্ছেদের অন্য অংশে বিধৃত হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ধর্মের সমঅধিকার বাস্তবায়ন করতে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হোক।
ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে বরাদ্দ নিরূপণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঠিক শুমারির উদ্যোগ নেয়া হোক।
ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পাদন ও ধর্মীয় সংস্কৃতির উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মডেল মন্দির/প্যাগোডা/গির্জা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনে বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া হোক।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি নিমচন্দ্র ভৌমিক বলেন, ‘বিরোধী দলগুলো যদি প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র চায়, তাহলে তাদেরকে বাহাত্তরের সংবিধান মানতে হবে। সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোও সংখ্যালঘুদের বৈষম্য নিয়ে কথা বলছে না, বরং তারা উসকানিমূলক মন্তব্য করছে।’
নিমচন্দ্র ভৌমিক বলেন, ‘দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিরোধী দলগুলো যদি প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র চায়, তাহলে তাদেরকে বাহাত্তরের সংবিধান মানতে হবে। ধর্মনিরেপক্ষতা মানতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিপীড়ন সম্ভব নয়।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৭
আপনার মতামত জানানঃ