স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল শিনজিয়াংয়ে উইঘুরসহ অন্য মুসলিমদের ‘নির্বিচার’ ও ‘বৈষম্যমূলক’ আটকের মধ্য দিয়ে চীন মানবতাবিরোধী অপরাধ করে থাকতে পারে বলে উঠে এসেছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে।
জাতিসংঘের বিদায়ী মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট রচিত দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তরের ৪৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী ও উগ্রপন্থাবিরোধী কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কারণে শিনজিয়াংয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, ‘উইঘুর ও মুসলিমপ্রধান অন্য জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নির্বিচার ও বৈষম্যমূলক আটকের ব্যাপকতায়… আন্তর্জাতিক অপরাধ, আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হতে পারে।’
প্রতিবেদনে শিনজিয়াংয়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কারাগার কিংবা বন্দিশালায় আটক ব্যক্তিদের মুক্তিতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে চীন সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন জাতিসংঘের সদ্য সাবেক মানবাধিকারপ্রধান।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়, চীনের বিষয়ে অতি নরম অবস্থানের অভিযোগে কিছু কূটনীতিক ও মানবাধিকার সংস্থার সমালোচনায় পড়া ব্যাচেলেটের চার বছর মেয়াদ পূর্ণ হয় বুধবার। দায়িত্ব ছাড়ার আগ মুহূর্তে হাইকমিশনার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন, যিনি চলতি বছরের মে মাসে চীন সফর করেছিলেন।
অবশ্য প্রতিবেদনটি প্রকাশ না করার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আগেই আহ্বান জানিয়েছিল চীন। তবে সেই আহ্বান ব্যর্থ হওয়ার পর এখন বেইজিং এই রিপোর্টেকে পশ্চিমাদের সাজানো ‘প্রহসন’ বলে অভিহিত করেছে। বৃহস্পতিবার (১ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, জিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুর মুসলিম এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে চীনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে মূলত সেসবই মূল্যায়ন করা হয়েছে। মূলত উইঘুর মুসলিমসহ অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি চীন বরাবরই অস্বীকার করে থাকে।
তবে তদন্তকারীরা বলছেন, তারা চীনা কর্তৃপক্ষের নির্যাতনের ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ উন্মোচন করেছেন এবং সেগুলো সম্ভবত ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’। তারা সংখ্যালঘুদের অধিকারকে দমন করার জন্য অস্পষ্ট জাতীয় নিরাপত্তা আইন ব্যবহার এবং ‘স্বেচ্ছাচারীভাবে আটকের ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার জন্য চীনকে অভিযুক্ত করেছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় থেকে অনুমোদিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্দিদের নির্যাতন এবং তাদের সাথে করা ‘অপরাধের নিদর্শনের’ মধ্যে ‘যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার ঘটনাও’ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
নির্বিচার বন্দিত্বের শিকার ভুক্তভোগীরা জোরপূর্বক চিকিৎসা এবং ‘পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতির বৈষম্যমূলক প্রয়োগের’ সম্মুখীন হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, নির্বিচার বন্দিত্বের শিকার ভুক্তভোগীরা জোরপূর্বক চিকিৎসা এবং ‘পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতির বৈষম্যমূলক প্রয়োগের’ সম্মুখীন হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
বেশ কয়েকটি দেশ এর আগে জিনজিয়াংয়ে চীনের পদক্ষেপকে গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছিল। তবে জিনজিয়াং অঞ্চলে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে বেইজিং। দেশটির দাবি, জিনজিয়াংয়ের ক্যাম্প বা বন্দিশিবিরগুলো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি হাতিয়ার।
রিপোর্টে বেইজিং, জাতিসংঘ এবং বৃহত্তর বিশ্বকে জিনজিয়াংয়ের পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য সরকার, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও বিস্তৃতভাবে জরুরি মনোযোগ প্রয়োজন।’
তবে, রিপোর্টে গণহত্যার কোনো উল্লেখ করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর মূল অভিযোগগুলোর মধ্যে এটি ছিল অন্যতম।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের প্রধান হিসেবে চার বছর দায়িত্বপালনের পর মিশেল ব্যাচেলেটের মেয়াদের শেষ দিনে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। উইঘুরদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগটি তার মেয়াদে প্রাধান্য পেয়েছে।
সংবাদমাধ্যম বলছে, প্রায় এক বছর ধরে এই রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। যদিও এই রিপোর্ট প্রকাশ না করার জন্য যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছিল বেইজিং। তবে চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট রিপোর্টটি প্রকাশে বদ্ধপরিকর ছিলেন।
তিনি বলেছেন, ‘আমি বলেছিলাম যে আমার মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগেই আমি এটি প্রকাশ করব এবং আমি তা করেছি।’
এর আগে গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যাচেলেট স্বীকার করেন, প্রতিবেদনটি প্রকাশ না করার জন্য প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিলেন তিনি। অবশ্য এই রিপোর্ট প্রকাশ হতেই বিরোধিতায় নেমে পড়েছে চীন।
জাতিসংঘে চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন বলেছেন, ‘তথাকথিত জিনজিয়াং ইস্যুটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে সম্পূর্ণ বানানো এবং এর উদ্দেশ্য অবশ্যই চীনের স্থিতিশীলতা নষ্ট করা এবং চীনের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করা। পশ্চিমা দেশগুলোর চাপে না পড়ে ব্যাচেলেটের স্বাধীন থাকা উচিত ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই রিপোর্ট কেবল জাতিসংঘ এবং একটি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতাকে ক্ষুণ্ন করে। এটি চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পুরোপুরি হস্তক্ষেপ।’
২০১৭ সালের এপিল থেকে ২০ লাখের বেশি উইঘুর ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের জোরপূর্বক বন্দিশিবিরে রেখেছে চীন সরকার। দেশটির জিনজিয়াং প্রদেশে প্রায় ৮৫টি বন্দিশিবিরের হদিস পাওয়া গেছে। সেখানে উইঘুর ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি আজারবাইজান, উজবেকস, কাজাকস ও তুর্কমেন্সের মতো সংখ্যালঘু মানুষদের আটকে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জিনজিয়াংয়ে থাকা একসময়ের বন্দিরা অভিযোগ করেছেন, বন্দিশিবিরে জোর করে রাজনৈতিক মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করা, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করা, নির্যাতন করা, এমনকি যৌন নিপীড়নও করা হয়। যদিও চীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। উল্টো এসব বন্দিশিবিরকে ‘কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র’ বলে দাবি করেছে তারা।
চীন সরকার এ বন্দি শিবিরকে ‘চরিত্র সংশোধনাগার’ নাম দিয়েছে। চীন সরকারের দাবি, উশৃংঙ্খল অবস্থা থেকে নিরাপদ ও সুরক্ষা দিতেই তাদের এ কার্যক্রম। চরিত্র সংশোধনাগারের নামে চীন সরকার এ সব মুসলিমদের প্রতি চরম অত্যাচার ও নির্যাতন করছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তা উঠে এসেছে। আর এসব দমন-পীড়নের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংসহ অন্য চীনা নেতাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার তথ্য ফাঁস হয়েছে।
চীন সরকারের জুলুম অত্যাচার থেকে বাঁচার লক্ষ্যে জিনজিয়াংয়ের প্রায় ২৫ লাখ অধিবাসী পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। নানা অজুহাতে উইঘুর মুসলিম নেতৃস্থানীয়দের জেল-জুলুম এমনকি মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে সরকার।
চীন সরকার কর্তৃক এসব অত্যাচার নির্যাতনে এখনও কোনো উইঘুর মুসলিম প্রতিরোধমূলক কিংবা আত্মরক্ষামূলক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তারপরও দেশটির সরকার উইঘুর মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে বর্হিবিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে প্রবাহিত করছে। অথচ দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২২২
আপনার মতামত জানানঃ