জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের ২ গ্রুপের সংঘর্ষের সময় পুলিশ লাঠিচার্জ করে। পুলিশের এই লাঠিচার্জ নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিশেষ করে সরকার দলীয়দের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একইসাথে ফুঁসে উঠেছেন ওই এমপি এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ ।
এরইমধ্যে বরগুনার অ্যাডিশনাল এসপি মহররম আলীকে বরিশালে বদলি করা হয়েছে। আরো পাঁচ পুলিশ সদস্যকে অন্য জেলার পুলিশ লাইনে পাঠানো হয়েছে। গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। এখন বরগুনা আওয়ামী লীগ ওই অ্যাডিশনাল এসপিসহ দায়ী পুলিশ সদস্যদের বরখাস্তের দাবিতে আন্দোলন করছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “পুলিশ বরগুনায় বাড়াবাড়ি করেছে। এতটা বাড়াবাড়ি ঠিক হয়নি।”
অবশ্য প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের এই আচরণ নতুন কী না। আর পুলিশের বাড়াবাড়ি একমাত্র বরগুনায়ই ঘটেছে কী না। অন্য দলের নেতা কর্মীদের ওপর পুলিশ হামলা চালালে, লাঠি পেটা করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরগুনার ঘটনার মত প্রতিক্রিয়া জানান কী না। পুলিশের শীর্ষ কর্মকতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় কী না?
বিরোধী দল-মতের কর্মসূচিতে পুলিশকে প্রতিনিয়তই লাঠিচার্জ করতে দেখা যায়। গত ৭ আগস্ট জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধির প্রতিবাদে শাহবাগে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ। ভোলায় বিএনপির সমাবেশে গুলি চালায়, ২ জন নিহত হয়। এইসব ঘটনায় পুলিশের বাড়াবাড়ি থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা উল্টো বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
বরগুনায় ছাত্রলীগের ওপর লাঠিচার্জের ঘটনায় যারা কথা বলছেন, অন্য সময় তাদের নীরব থাকতে দেখা গেছে। অনেকে পুলিশের পক্ষে কথা বলেছেন।
এগুলো হঠাৎ কোনো ঘটনা নয়। ধারাবাহিকভাবে ঘটছে এবং প্রায় প্রতিদিনই হচ্ছে। গত এক মাসে বিএনপি ও বাম সংগঠনের সারাদেশে প্রতিবাদ সমাবেশে এরকম ৫০টিরও বেশি ছোট-বড় হামলা ও লাঠিপেটা করেছে পুলিশ।
আর বরগুনার ঘটনা হলো ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে পদ না পাওয়ারা যারা পদ পেয়েছে তাদের ওপর হামলা চালায়। ওই হামলা থামাতে গেলে তারা পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করে। পুলিশ ওই ভাঙচুরের জবাব দেয় বিদ্রোহীদের ব্যাপক লাঠিপেটার মাধ্যমে।
বিদ্রোহীরা হলো আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর অনুসারী। একমাস আগে নতুন কমিটি গঠন হলে সেখানে শম্ভুর অনুসারীরা জায়গা পায়নি । শম্ভু তাই তার অনুসারীদের দিয়ে গত এক মাস ধরে মহড়া করিয়ে আসছিলেন। ঘটনার দিন শম্ভু সেখানে উপস্থিত হলে পুলিশ তার সঙ্গেও তর্কে লিপ্ত হয়।
মানবাবিধকার কর্মী নূর খান ডয়েচেভেলেকে বলেন,“পুলিশের এই আচরণ অত্যন্ত নিন্দনীয় কিন্তু তারা সরকার বিরোধীদের ওপর যখন হামলা চালায় তখন পুলিশের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে দেখি না। বিররোধী দল, বিরোধী মতকে দমন করায় পুলিশকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভোলায় তো দুই জনকে গুলি করে হত্যাই করা হলো।”
“পুলিশের এই আচরণ অত্যন্ত নিন্দনীয় কিন্তু তারা সরকার বিরোধীদের ওপর যখন হামলা চালায় তখন পুলিশের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে দেখি না। বিরোধী দল, বিরোধী মতকে দমন করায় পুলিশকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভোলায় তো দুই জনকে গুলি করে হত্যাই করা হলো।”
তার কথা,“পুলিশকে অব্যাহতভাবে ব্যবহারে ফলে এখন যা হচ্ছে তাহলো তারা সরকারি দলের লোকজনের ওপরও চড়াও হচ্ছে। সরকারের দ্বিচারিতার ফল এটা।”
আর্টিক্যাল নাইনটিনের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন,“ভোলার ঘটনায় পুলিশের আচরণে সরকার এখন রিঅ্যাক্ট করছে। কিন্তু যখন অন্য দলের ছেলেদের পুলিশ পিটায় তখন সরকার রিঅ্যাক্ট করে না। ভোলার ঘটনায় সরকার এখন পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে তাতে আমরা খুশি। কিন্তু বিরোধীদের ওপর যে পুলিশ হামলা করেছে সে ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নেবে? এপর্যন্ত তা নিতে দেখিনি।”
পুলিশের এই আচরণ দিনে দিন বাড়ছে বলে মনে করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। এটা সব সময়েই হয়ে আসছে বলে মনে করেন তিনি। তার কথা,“ভোলার ঘটনায় সরকার পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে এটাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু শুধু ছাত্রলীগকে পিটিয়েছে সে কারণে যদি ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলে সেটা তো ভালো কিছু নয়। পুলিশ দেশের নাগরিক বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সাথে যে আচরণ করে তার বিরুদ্ধেও তো ব্যবস্থা নিতে হবে।”
তিনি বলেন,“ দীর্ঘদিনের প্রাকটিসের কারণে বাংলাদেশে পুলিশের ভিতরে এখন আর সেবার মানসিকতা আছে বলা যাবে না। তারা মনে করে তারা যেভাবে চাইবে সেভাবেই হবে।”
পুলিশের সব পরিস্থিতিতেই সবার সঙ্গে সহনশীল আচরণ করা উচিত বলে মনে করেন সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ। তবে সেই আচরণ সব সময় পাওয়া যায় না। তার কথা,“আমাদের এখানে পুলিশের আচরণে হেরফের হয়। আমরা দীর্ঘদিন যেভাবে বেড়ে উঠেছি তাতে এরকম হওয়ার কারণ আছে।”
তিনি বলেন,“ শুধু মাত্র পুলিশ নিজের এবং দেশের নাগরিকদের জান মাল রক্ষায় গুলি চালাতে পারে। কিন্তু তাকে সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। মুখের ভাষা ঠিক রাখতে হয়।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না দি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সরকার দলীয় কারো ওপর লাঠিচার্জ করলে কৈফিয়ত চাওয়া হয়, তখন আইনের ব্যত্যয় ঘটে। কিন্তু, দেখা যায় অন্য কারো ওপর করলে তখন আর আইনের ব্যত্যয় ঘটে না। এভাবে তো আইনের শাসন হয় না। পুলিশকে বেআইনিভাবে লাঠিচার্জ করতে শেখানো হয়েছে।’
‘আমরা শাহবাগে দেখি আন্দোলনকারীরা ভাঙচুর করে না, পুলিশকে আঘাত করে না। তারপরেও শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এ অভ্যাস তৈরি করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র দায়ী। কোনো কিছু পক্ষে হলে রাষ্ট্রযন্ত্র বলে সেটা ন্যায়, বিপক্ষে গেলেই বলে অন্যায়। আইনের ব্যাখ্যা সবসময় এক হওয়া উচিত। কিন্তু, তারা প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা পরিবর্তন করে’, যোগ করেন তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৪
আপনার মতামত জানানঃ