“চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসলে বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করে শরিয়াহ আইনে দেশ চলবে, সব ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে” – হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রিয় নেতা মামুনুল হকের এমন বক্তব্যের মাধ্যমে ভাস্কর্য বিতর্কের শুরু। মামুনুল হকের ভাস্কর্য নিয়ে বক্তব্যটি যতটা ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে, তারচেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন- চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসলে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করে দেশে শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের সকল ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করবেন। স্পষ্টতই তাঁর বক্তব্যটি বিদ্যমান সংবিধানকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। তার সঙ্গে আছেন চারদলীয় জোট। অর্থ্যাৎ বিএনপিসহ সমমনাদলগুলোর বক্তব্য হিসাবে হেফাজত নেতা মামুনুল হক তাঁর বক্তব্যটি দিয়েছে। এমন বক্তব্য দেওয়ার পরপরই বাংলাদেশের কয়েকটি স্থানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে চারদলীয়জোটের লিডিং রাজনৈতিক দল বিএনপি’র এই ইস্যুতে কোনও বক্তব্য নাই। তাদের এই নির্লিপ্ততা রাজনৈতিক মাঠে বেশ রহস্যজনক বলে মনে করছেন দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক পক্ষ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দেশের প্রগতিশীল নেতাদের এমন অভিযোগের বিষয়ে সংবাদ মাধ্যম দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে আমি কোন মন্তব্য করবেন না বলে জানিয়েছেন এবং মন্তব্য না করার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন, এ বিষয়ে মন্তব্য না করাটাই তাঁদের রাজনৈতিক কৌশল।
হেফাজত ইসলামকে নব্য জামায়াতি আখ্যায়িত করে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বর্ষীয়ান বাম নেতা পংকজ ভট্টাচার্য্য একই সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য ও বাহাত্তরের সংবিধান বাদ দিয়ে শরিয়াহ আইনে দেশ চালানোর হুঙ্কার বাঙালি জাতির জন্য একটা অশুভ সংকেত। পাকিস্তানপন্থি সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এ দেশে ১৯৭৫ সালের পরে জিয়া-এরশাদের হাত ধরে পুনর্বাসিত হয়েছে। জিয়া-এরশাদ জবরদস্তি করে এ দেশের মানুষকে পাকিস্তানের পথে হাঁটিয়েছে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় এসে আবার আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে শুরু করেছে পাকিস্তানপন্থি মৌলবাদী অপশক্তিকে। আওয়ামী লীগও ক্ষমতার জন্য সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস করেছে বিভিন্ন সময়ে। এসবের বহির্প্রকাশ আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। তিনি বলেন, আমাদের আত্মোপলব্ধি করে আত্মশুদ্ধির সময় এসেছে। তাহলেই শুধু বাহাত্তরের সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধ অপরাজেয় থাকবে। হেফাজতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক রয়েছে দাবি করে পংকজ বলেন, বিএনপির নিশ্চুপ থাকাই এর প্রমাণ।
বরাবরাই হেফাজত ইসলাম নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে দাবী করে আসলেও রাজনৈতিক সংগঠন/সংগঠনগুলোর সমর্থনের জোরেই তারা মাঠে অতীতে যেমন সক্রিয় ছিল বর্তমানেও তেমনটা সক্রিয় আছে। সংগঠনটির কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা পর্যাের নেতারা বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জড়িত। ২০১৩ সাল থেকে অদ্যবদি হেফাজত ইসলামের বিভিন্ন পর্যায়ের দাবীগুলো ছিল রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তাদের বিভিন্ন ধরণের বোঝাপড়া লক্ষ্য করা গেছে।
২০১৩ সালে ১১ দফা দাবী নিয়ে হেফাজত যখন মাঠ গরম করছিল তখন আওয়ামী বিরোধী সকল রাজনৈতিক দলের সাথে তাদের সখ্যতা বেশ স্পষ্ট ছিল। তখন জামায়াত-বিএনপি’র রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে হেফাজতকে বেশ সক্রিয় দেখা গেলেও হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আল্লামা শফি’র মাধ্যমে আওয়ামীলীগের সাথে সমঝোতা হয়। সেই সমঝোতার বিনিময়ে হেফাজতের অনেকগুলো দাবী ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ মেনে নেয়। হেফাজতের কেন্দ্রিয় নেতাদের রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। হেফাজতের সাথে সরকারের সেই সময়ের সমঝোতাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ব্যঙ্গ করে ‘সামাজিক সংগঠনের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতা’ বলে আখ্যায়িত করত। সবকিছু ঠিকমতই চলছিল।
সরকারের সাথে হেফাজতের পক্ষ থেকে সেই সময় হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশের প্রচার সম্পাদক ও আল্লামা শফির পুত্র আনাস মাদানী সবধরণের দেনদরবার করতেন। আল্লামা শফির জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তিত্বের কারণে সেই সময় বিএনপিপন্থি বা আওয়ামীলীগ বিরোধী হেফাজত নেতারা কার্যত সংগঠনটির মধ্যে কোনঠাসা হয়ে ছিলেন। তারা চাইলেও সরকারের বিরুদ্ধে বড় আকারের কোন ধরনের কর্মসূচি নিতে পারেনি।
বিপত্তি ঘটল আল্লামা শফির মৃত্যুর মাধ্যমে। শফিপূুত্র আনাস মাদানী হয়ে পড়লেন কোনঠাসা, হেফাজতের নেতৃত্বে চলে আসলেন বিএনপিপন্থি নেতারা। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের সাথে হেফাজতসহ ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘদিনের প্রেমে ছেদ ঘটল। ধর্মের দোহাই দিয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতারা মাঠে নামলেও কার্যত রাজনৈতিক সমর্থনের জোরেই তারা মাঠে সবসময় সক্রিয় ছিল বলে মনে করছেন প্রগতিশীল বলে পরিচিত রাজনৈতিক নেতারা। এদের সঙ্গে বিএনপির সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলেও সন্দেহ তাদের। তারা মনে করেন, তা না হলে ভাস্কর্যবিরোধী ইস্যুতে বিএনপি চুপ কেন?
১৪ দলীয় জোট নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন মনে করেন, হেফাজত নেতারা বিভিন্ন দল থেকে এখানে এসে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে হেফাজতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে আর তাই সাম্প্রদায়িক এই অপশক্তি ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে টেনে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে। ভাস্কর্য নিয়ে মামুনুল হকের বক্তব্যের পর রহস্যজনকভাবে বিএনপির নেতা নিশ্চুপ রয়েছে। তাদের কাছ থেকে আশকারা পেয়ে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে বাহাত্তরের সংবিধান পরিবর্তন করে ফেলা দেশে কোনো ভাস্কর্য থাকবে না বলে ঘোষণা দেওয়ার সাহস দেখিয়েছে। মেনন বলেন, হেফাজতের নাকের ডগায় জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্য আছে সেটা নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু’র মতে, যারা ভাস্কর্যবিরোধী কথা বলছে তাদের বেশিরভাগই ২০ দলীয় জোটের হেফাজত নেতা। আর এ জোটের নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সংবিধানের চার নীতি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে বাহাত্তরের সংবিধান সংসদে পুনঃপ্রবর্তন করার সময় অধিবেশন বর্জন করে। বিএনপি সংবিধানের চার মূলনীতি মানে না, জাতির পিতা মানে না। মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশবিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি। তাদের লাইনেই কথা বলেছেন মামুনুল হক।
ভাস্কর্যবিরোধী ইস্যু সামনে এনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চার মূলনীতি ধ্বংস করতে চায় বলে মনে করেন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম। হেফাজতের এসব বক্তব্যের ব্যাপারে বিএনপির চুপ থাকা নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক বলেন, হেফাজতের সঙ্গে বিএনপির ভাবগত ও আদর্শগত মিল রয়েছে। ফলে তারা তো চুপই থাকবে।
সর্বপরি, রাজনৈতিক বিশ্লেষকগনও ভাস্কর্য ইস্যুতে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি’র চুপ থাকাকে রহস্যজনক বলেই মনে করছেন। দেশের সাধারণ মানুষও ভাস্কর্য ইস্যুতে বিএনপির চুপ থাকাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। তবে দেশ কী একটি অস্থিতিশীল সময়ের পথে হাটছে?
এসডব্লিউ/নসদ/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ