বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই শিশুদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান ভাবা হয় তার বাড়িকে৷ অথচ সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে আমাদের দেশে বাড়িতেই সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছে শিশুরা।
জরিপে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা গেছে, ঘরেই শতকরা ৯৫ দশমিক ৮ জন শিশু নির্যাতিত হচ্ছে নানাভাবে। শিশুরা পরিবারে সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয় বাবা-মা ও অভিভাবকদের দ্বারা। শান্তি ও নিয়মানুবর্তিতার কথা বলে শিশুর ওপর এই নিপীড়ন চালানো হয়।
বেসরকারি সংস্থা ইনসিডিন বাংলাদেশের এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার (৭ জুন) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ‘বাংলাদেশে শিশুর প্রতি সহিংসতা পরিস্থিতি’ শীর্ষক জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম অনুষ্ঠানে সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও অনুষ্ঠানে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার উপস্থিতিতে গবেষণার মূল বিষয় উপস্থাপন করা হয়।
সভায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য স্থানীয় সরকার পর্যায়ে শিশু বাজেটে ১০ শতাংশ বরাদ্দের দাবি জানান। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শিশুর ব্যবহার বন্ধের ওপরও জোর দেন তিনি।
জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘরের বাইরে, কাজের জায়গা বা অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানে শিশু যতটা নির্যাতিত হচ্ছে, এর চেয়ে বেশি নির্যাতিত হচ্ছে নিজ গৃহে। প্রতিবন্ধী শিশুরাও শুধু প্রতিবন্ধিতার কারণে পরিবারে ও সমাজে নিগৃহীত হচ্ছে।
এছাড়া পর্নোগ্রাফিতে শিশুদের প্রবেশাধিকারের বিষয়টিও জরিপে উঠে এসেছে।
জুন ২০২০ থেকে মে ২০২১ পর্যন্ত মোট ১১টি জেলায় এই জরিপ চালানো হয়। জেলাগুলো হচ্ছে— ঢাকা, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, যশোর, ঝিনাইদহ, খুলনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, কুমিল্লা ও রাঙামাটিতে এই জরিপটি চালানো হয়েছে।৫ হাজার ৭৪ জন শিশুর ওপর এ জরিপ চালানো হয়। এদের মধ্যে শহরের ৩ হাজার ১৩৪ জন শিশু এবং গ্রামের ১ হাজার ৯৪০ জন।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯৫.৩% শিশু জানিয়েছে, তারা জীবনের কোনো না কোনো সময় ঘরে, বাইরে, স্কুলে বা কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৯৬.২% মেয়েশিশু এবং ৯৪.৫% ছেলেশিশু।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘরের বাইরে, কাজের জায়গা বা অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানে শিশু যতটা নির্যাতিত হচ্ছে, এর চেয়ে বেশি নির্যাতিত হচ্ছে নিজ গৃহে। প্রতিবন্ধী শিশুরাও শুধু প্রতিবন্ধিতার কারণে পরিবারে ও সমাজে নিগৃহীত হচ্ছে। এছাড়া পর্নোগ্রাফিতে শিশুদের প্রবেশাধিকারের বিষয়টিও জরিপে উঠে এসেছে।
জরিপে অংশ নেওয়া ৮৬.৯% শিশু জানান, তারা বাড়িতে শারীরিকভাবে সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
বাসায় থাকা শিশুরা জানিয়েছে ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থার’ নামে তাদের ওপর অত্যাচার করা হয়। অন্যদিকে প্রায় ৮১% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বলেছেন, সন্তান যদি বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়, তাহলে তারা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে শিশুকে শারীরিক শাস্তি দেওয়ার পক্ষে। এক্ষেত্রে ছেলেশিশুরা মেয়েশিশুদের চেয়ে শারীরিক শাস্তি বেশি ভোগ করে। ছেলেশিশু ৮৮.৪% আর মেয়েশিশু ৮৪.১%। ৫৫% শিশু জানিয়েছে, তারা পরিবারের ভেতরেই যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। গৃহে মেয়েশিশুর ৫০% চেয়ে ছেলেশিশুই ৬০% বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
শিশুকে শারীরিকভাবে অত্যাচার করার মধ্যে হাত, জুতা, বেল্ট, বোতল দিয়ে মারা, লাথি মারা, টানাহেঁচড়া করা, চুল টানা, দাঁড় করিয়ে রাখা, হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা, শরীর পুড়িয়ে দেওয়া, অতিরিক্ত শ্রম করানো এবং ভয় ঝাঁকি দেওয়া, ছুড়ে ফেলা, চিমটি দেখানো।
জরিপে অংশ নেওয়া ৮২% শিশু নির্যাতিত হয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিশু অর্থাৎ ৮৬.১% শিশু ইমোশনালি বা মানসিকভাবে নিপীড়িত হয়েছেন। ৮২% শারীরিক সহিংসতার শিকার; আর ২৪.১% শিশু যৌন হয়রানির শিকার হন।
ইমোশনাল হয়রানির মধ্যে পড়ে ছোট করা, আজেবাজে নামে ডাকা, ভয় দেখানো, গালাগালি করা, হুংকার দেওয়া, ইয়ার্কি করা, বুলিং করা, শারীরিক ত্রুটি নিয়ে ঠাট্টা করা, সামাজিকভাবে হেয় করা, সমালোচনা করা, অভিশাপ দেওয়া, লজ্জা দেওয়া, অবহেলা করা। এই হয়রানিগুলো শিশুকে মানসিক ও শারীরিকভাবে বড় হতে দেয় না।
বাসায় থাকা শিশুরা জানিয়েছে ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থার’ নামে তাদের ওপর অত্যাচার করা হয়।
৬৭.১% শিশু ঘরের বাইরে বা এলাকায় বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়। এর মধ্যে ৮৪.৬% শিশুকে ইমোশনালি হয়রানি করা হয়, শারীরিকভাবে হয়রানি করা হয় ৬৭.১% শিশুকে এবং যৌন হয়রানির শিকার হয় ২৪.১%। ৫৫.৩% শিশুকে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার হতে হয়। এর মধ্যে ৭২% ইমোশনালি হয়রানির শিকার হয়, শারীরিক নিপীড়ন ৫৫.৩% এবং যৌন হয়রানি ৩৭.৮% শিশু। এদের মধ্যে মেয়েশিশু ৩৯.৩% এবং ছেলেশিশু ৩৬.৬%।
২৬.৯% শিশু এমন প্রতিষ্ঠানে সহিংসতার শিকার হচ্ছে, যেখানে তারা অবস্থান করে বা সেবা গ্রহণ করে। এখানে বসবাসরত ১১.৯% মেয়েই শুধু যৌন হয়রানির কথা বলেছে।
এই যে পরিবারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, পাড়া বা মহল্লায় এবং কর্মক্ষেত্রে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, তাহলে কেন তারা এই বিষয়ে মুখ খোলেনি, এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে শতকরা ৬১ দশমিক ৭ জন বলেছে যে লজ্জা এবং বাবা-মা ও অভিভাবকের ভয়ের কারণে মুখ খোলে না। শতকরা ৫২ দশমিক ৭ জন বলেছে, তারা তখন বুঝতে পারেনি যে তাদের প্রতি যৌন হয়রানি করা হচ্ছে। অপরাধী হুমকি দেওয়ার কারণে চুপ থেকেছে ৩০ দশমিক ১ ভাগ শিশু। যৌন অপরাধ যারা করে, তারা স্নেহ ও ভালোবাসার ছদ্মাবরণে এটা করে বলে জানিয়েছে ১৬ দশমিক ২ ভাগ শিশু। ১৫ দশমিক ৬ জন শিশু বলেছে তারা ঠিক জানে না পরিবারের বাইরে কোথায় গিয়ে এই বিষয়ে অভিযোগ জানাতে হয়।
ছাত্রছাত্রী দুজনই বলেছে সাধারণ শিক্ষক/শিক্ষিকারাই সবচেয়ে বেশি তাদের ওপর নিপীড়ন করে। তবে এর বাইরে আছে প্রধান শিক্ষক, শরীরচর্চা শিক্ষক, ধর্ম শিক্ষক, গার্ড, অন্য স্টাফ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের কেউ কেউ। সমাজে বা ঘরের বাইরে প্রতিবেশী, চাকরিদাতা, সঙ্গীসাথি, শিক্ষক, অপরিচিত ব্যক্তি, দোকানদার এবং আইন রক্ষাকারী সংস্থার লোক শিশুদের হয়রানি করে। আর যেসব শিশু কাজ করে বা কর্মজীবী তারা বলেছে তাদের সঙ্গী, মালিক, মালিকের পরিবারের লোকজন, নিরাপত্তারক্ষী এবং সুপারভাইজাররা তাদের ওপর অত্যাচার করে।
এ ছাড়াও এনজিও দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠানেও শিশুরা অন্য বয়স্ক শিশু, স্টাফদের দ্বারা নিপীড়িত হয়। এর মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে শিশুবিষয়ক নিরাপত্তা নীতি বা পলিসি এখানেও কাজ করছে না।
শতকরা ৬২ দশমিক ১ জন প্রতিবন্ধী শিশু বলেছে শুধু প্রতিবন্ধী শিশু হওয়ার কারণে তারা পরিবারে ও সমাজে হয়রানির শিকার হয়ে থাকে। এর মধ্যে ছেলেশিশু ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মেয়েশিশু ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ।
জরিপ প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে বলা হয়েছে, নীরবতার সংস্কৃতি ভাঙতে হবে। শিশুর প্রতি যে কোনো ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে হবে। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য তার জন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে অনিরাপদ পারিবারিক অভিবাসন থামাতে হবে। শিশুর প্রতি যে অপরাধ করবে, শিশুকে নির্যাতন করবে তাকে ভালোভাবে বোঝাতে হবে এবং প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কমিউনিটিভিত্তিক শিশু সুরক্ষা পলিসি গ্রহণ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুকে শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে কখনো তাকে মানুষ করে তোলা সম্ভব নয়। বরং এই ব্যবস্থা শিশুর মনোজগতে এতটাই বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে যে, শিশুটি বড় হতে পারে একজন অপরাধী হিসেবে, নয়তো অমানবিক বা অসামাজিক মানুষ হিসেবে বা সমাজের নিকৃষ্ট কীট হিসেবে। এই নিপীড়ন, নির্যাতন তাকে পথভ্রষ্ট ও উচ্ছৃংখল করে তুলতে পারে।
শিশুকে যদি মানসিকভাবে হয়রানি করা হয়, সেই শিশুও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে বড় হতে বাধ্য। ইদানিং বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ আসছে যে শিশু তার সহপাঠী, বন্ধু, শিক্ষক বা বড়দের কাছ থেকে বুলিং এর শিকার হচ্ছে, যা শিশুকে অস্থির, বিমর্ষ ও নিঃসঙ্গ করে তুলছে। শিশু হয়ে উঠছে সুইসাইডাল বা অপরাধী মানসিকতার ও দুর্বল চিত্তের।
তারা বলেন, এই যে পরিবারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, পাড়া বা মহল্লায় এবং কর্মক্ষেত্রে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, এটা তাদের জন্য কতটা ভয়াবহ পরিণাম বয়ে আনবে, তা কল্পনাও করা যায় না। শিশুর মনে তৈরি হয় অবিশ্বাস, ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা। সে কারো কাছে কিছু বলতে পারেনা বলে নিজেকে অপরাধী বলে মনে করতে থাকে।
সমাজে সবধরণের অপরাধ বাড়ছে। নারী ও শিশু নির্যাতন লাগামছাড়া। অপরাধীদের চরিত্র ও সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এদের একটা বড় অংশ শিশু-কিশোর বা তরুণ। যে ব্যবহার পেয়ে তারা বড় হচ্ছে, ঠিক সেই ব্যবহারই তারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিচ্ছে ও দিবে। কাজেই শিশুর সাথে সে ব্যবহারই করা উচিৎ, যা আমরা তাদের কাছে ভবিষ্যতে প্রত্যাশা করি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৫
আপনার মতামত জানানঃ