দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই ধর্ষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সবথেকে কম কথা বলা হয়। এর কারণ হয়তো সেক্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক ভুক্তভোগী এবং ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মানুষের অন্ধবিশ্বাস।
মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক একের পর এক শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা মাদ্রাসা বিষয়ে দেশবাসীর নিকট এক নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হয়েছে।
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। আজ যারা শিশু, কাল তারাই বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে। আজ যারা বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, একদিন তারাও শিশু ছিলেন। তাই শিশুদের নিয়ে তাদের রয়েছে নানা ভাবনা। কিন্তু সারাদেশে বিভিন্ন মাদ্রাসায় বহু ছেলেশিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। আর এর জন্য দায়ী হচ্ছেন কখনো খোদ মাদ্রাসা শিক্ষক তথা মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা।
এবার সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার এক ছাত্রকে (১৪) ধর্ষণের অভিযোগে মাওলানা ফয়েজ উদ্দিন (৫০) নামের এক মাদ্রাসাশিক্ষককে পিটুনি দিয়ে পুলিশে দিয়েছেন এলাকার বাসিন্দারা। গতকাল রোববার রাত সাড়ে আটটার দিকে মাদ্রাসা থেকে ফয়েজ উদ্দিনকে আটক করে পিটুনি দেওয়ার পর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এ ঘটনায় ওই শিক্ষার্থীর পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ফয়েজ উদ্দিন উপজেলার মুহাম্মদিয়া তাহফিজুল কোরআন মাদ্রাসার মুহতামিম।
পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই মাদ্রাসার এক আবাসিক শিক্ষার্থীকে (১৪) গত মার্চ ধর্ষণ করেন ফয়েজ উদ্দিন। ওই শিক্ষার্থী যেন ঘটনাটি কাউকে না জানায়, সে জন্য ভয়ভীতি দেখিয়েছিলেন তিনি। গত শনিবার একইভাবে ওই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণচেষ্টা করলে সে পালিয়ে বাড়িতে চলে যায়। গতকাল সকালে ওই শিক্ষার্থীর পরিবার তাকে মাদ্রাসায় যেতে বললে সে অস্বীকৃতি জানায়। পরে একপর্যায়ে সে পরিবারের লোকজনের কাছে ঘটনাটি খুলে বলে। এরপর স্বজনেরা মাদ্রাসায় গিয়ে এলাকাবাসীকে বিষয়টি জানালে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওই শিক্ষককে পিটুনি দিয়ে রাতেই পুলিশে দেন। পুলিশ তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেছে।
গোলাপগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক ফয়জুল করিম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এ ঘটনায় ওই শিক্ষার্থীর পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্ষণের অভিযোগে থানায় মামলা করা হয়েছে। ওই মামলায় মাদ্রাসাশিক্ষক ফয়েজ উদ্দিনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ফয়েজ উদ্দিন আহত অবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ওই শিশুকেও হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঠানো হয়েছে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, মাদ্রাসাগুলোয় দিনের পর দিন ছেলে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চললেও তা বন্ধে এখনও তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বিপথগামী কিছু শিক্ষক ও মাদ্রাসাসংশ্নিষ্টরা এটাকে অপরাধ বলেই গণ্য করেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে ধর্মের নানা অপব্যাখ্যা দেন জড়িতরা। আবার ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করে রেখে তা ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে শিশুদের জিম্মি করার ঘটনাও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া অন্য মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি সেভাবে নেই। সেজন্য যৌন নির্যাতন বা শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ থাকে। এছাড়া সেখানে পরিবেশ এমন যে, শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অনেক সময় প্রকাশও হয় না। কওমি, এবতেদায়ী বা নূরানী-বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছে, তাদের তদারকি বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকে মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। এটিও সমাজের বৈকল্যতা।
তারা বলেন, এমন ঘটনা অনেক হচ্ছে, তবে তা জানা যাচ্ছে কম। যখন কেউ মারা যায় বা নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে তখনই কেবল তা প্রকাশ্যে আসে। মাদ্রাসা বোর্ডকে এ ব্যাপারে শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। কেন এসব ঘটছে তা খুঁজে বের করতে হবে। জড়িতদের যথাযথ শাস্তি দিতে হবে।
আরও বলেন, সেখানে এমন কোনো কমিটিও নেই যেখানে নির্যাতনের শিকার শিশুরা কথা বলতে পারবে। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র শিশুরা মাদ্রাসায় পড়ে বলে তাদের নানা অজুহাতে দমিয়ে রাখাও সহজ হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১৪
আপনার মতামত জানানঃ