তালিবান দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা দখলের পর এই প্রথম ঈদ উদযাপন করল আফগানবাসী। আফগানিস্তানজুড়ে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটায় রাজধানী কাবুলের বৃহত্তম মসজিদে বেশ ভয়ে ভয়েই ঈদের নামাজ আদায় করতে গেছেন মুসল্লিরা।
গত বছরের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেয় তালিবান। এরপর তারা নতুন সরকার গঠন করলেও এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে দেশটি। দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সংকট।
আফগানিস্তানে বর্তমানে ৯৭ শতাংশেরও বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। দেশটির অর্ধেকেরও বেশি মানুষের খাদ্য সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দিনে দু’বেলা খাবারের ন্যূনতম নিশ্চয়তাও নেই তাদের।
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে বলে শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে দেশটির বার্তাসংস্থা খামা প্রেস।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে আফগানিস্তানের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানায়, গত বছর নির্বাচিত আফগান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত তরে তালিবান। ২০ বছর পর তালিবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত ৯ মাসে সাধারণ আফগানদের আয় কমেছে প্রায় এক তৃতীয়াংশ।
শুক্রবারের প্রতিবেদনে খামা জানায়, চলতি বছরের মার্চ মাসে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আওতায় কাবুলের ৩ লাখ ৭৬ হাজার ১৩৯ জন বাসিন্দাকে খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আর কোনো আর্থিক সহযোগিতা পায়নি আফগানিস্তানের নাগরিকরা।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে খাদ্য সংকট শুরু হয় আফগানিস্তানে। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সেখানে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন ১ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ।
এই সংকট আরও চরম রূপ নেয় গত বছরের মাঝামাঝি থেকে, তালিবান সরকার আসীন হওয়ার পর। বিশ্বের বৃহত্তম ঋণ ও আর্থিক সহায়তা দানকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে আফগানিস্তানের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, তালিবানগোষ্ঠী আফগানিস্তানের জাতীয় ক্ষমতা দখলের পর গত প্রায় ৯ মাসে সাধারণ আফগানদের আয় কমেছে প্রায় এক তৃতীয়াংশ।
আফগানিস্তানে বর্তমানে ৯৭ শতাংশেরও বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। দেশটির অর্ধেকেরও বেশি মানুষের খাদ্য সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দিনে দু’বেলা খাবারের ন্যূনতম নিশ্চয়তাও নেই তাদের।
আফগানিস্তানের অর্থনীতি মূলত বিদেশি সহায়তানির্ভর। তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর থেকে জাতিসংঘ ব্যতীত অন্য সব দাতাগোষ্ঠী ও দেশসমূহ আফগানিস্তানে সহায়তা প্রদান বন্ধ রেখেছে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগানিস্তানে ঐতিহ্যগতভাবেই ধুমধামের সঙ্গে ঈদুল ফিতর উদযাপন করা হয়; কিন্তু এবারের ঈদ আফগানিস্তানে ছিল একেবারেই বিবর্ণ। ঈদের দিনও দেশটির বেশিরভাগ মানুষ পেট ভরে খেতে পাননি।
গত রোববার (১ মে) ঈদ উদযাপন করেছে আফগানিস্তানের মানুষ। কিন্তু লাখ লাখ মানুষের মধ্যে ঈদের কোনো আমেজ দেখা যায়নি। প্রায় প্রতিদিনই তিনবেলা খাবারের জন্য তাদের লড়াই করতে হচ্ছে।
জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কাবুলের একটি বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে ১০ সন্তানের বাবা দ্বীন মোহম্মদ এবারের ঈদ দুর্বিষহ হতে যাচ্ছে আশঙ্কা করে বলেছিলেন, দারিদ্র্যের কারণে কেউ আগের মতো ঈদ উদযাপন করতে পারে না। আমাদের যদি চাকরি আর কাজ থাকত, তাহলে আমরা নিজেদের জন্য কিছু কিনতে পারতাম। অন্যের দেওয়া খাবারের আশায় বসে থাকতে হতো না।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে আফগানিস্তান। গত বছরের আগস্ট মাসে তালিবানরা দেশটির ক্ষমতা দখলের পর থেকে মানবিক পরিস্থিতির তীব্র অবনতি হতে শুরু করেছে। দীর্ঘ দুই দশক যুদ্ধ চলাকালে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা দেশটিকে সহায়তা করে আসছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সরকারকে আগস্টে তালিবান ক্ষমতাচ্যুত করার পর ওই সব সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়। আর এর ফলেই সমূহ বিপদে পড়েছে দেশটি।
তালিবান নিয়ে বিশ্ব মোড়লদের সিদ্ধান্তহীনতা এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে। তালিবানের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তহীনতার ফল ভুগতে হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির লাখ লাখ মানুষকে।
এদিকে আফগানিস্তানের এখন যেখানেই যাওয়া হোক না কেন শিশু শ্রমিকদের দেখতে পাওয়া যায়। গাড়ি পরিষ্কার, আবর্জনার স্তূপ থেকে কিছু সংগ্রহ, জুতো পালিশ থেকে শুরু করে নানা ধরনের কাজ করছে তারা। নিজের ও পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতেই বই-খাতা ছেড়ে উপার্জনের পথে নামতে তাদের এ চেষ্টা।
খাদ্য সংকট কতটা চরমে পৌঁছালে একজন বাবা তার কন্যাসন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে একজন বাবার এছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। দেশে ভয়াবহ আর্থিক সংকট তৈরি হওয়ায় আফগানিস্তানের অনেক নাগরিককেই এখন এমন মর্মান্তিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
তালিবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই একের পর এক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে দেশটিতে। নিরাপত্তার অভাব, সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে দেশটি। মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
এদিকে, তালিবান সরকার গঠনের পর একের পর এক বিধিনিষেধ জারি করছে। যার ফলে দেশটির সংকট আরও তীব্র হচ্ছে।
আফগানিস্তান বরাবরই গরিব দেশ। সেখানকার ৭০ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারের কম। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, আগামী দিনে দেশটি আরও দরিদ্র হতে চলেছে। সেই দারিদ্রের মোকাবিলা করতে হবে তালিবান শাসকদের। তারা ইতিমধ্যেই বুঝতে পারছেন, দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর চেয়ে বেশি কঠিন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা তালিবান ভেবেছিল সরকার চালানো বোধহয় খুব সহজ। মানুষ খুন করা আর দেশ চালানো যে এক নয়, সেটা তারা বোঝেনি। দুর্নীতি আর বেহাল অর্থনীতি শুরুতেই কাঁধে চেপে বসেছে তালিবান শাসকদের। অর্থনীতি তো দূরের কথা, শান্তি ফেরাতেও হিমশিম খাচ্ছে দখলদার সরকার। ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালিবান। বোঝাতে চেয়েছিল, গত দুই দশকে তাদের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তারা যে বিন্দুমাত্র নিজেদের মানসিকতা বদলায়নি ক্ষমতায় এসেই চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়ে তারা সেটা আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক সাহায্যের বহর কমছে।
মনে করা হয়, তালিবানকে সাহায্য করা মানেই জঙ্গিবাদ ও মাদক চোরাকারবারীদের মদদ। আত্মঘাতী বোমারুদের যেমন তারা প্রকাশ্যেই উৎসাহিত করছে, তেমনি ক্ষমতায় আসার পর ফের মাদক ব্যবসার কথাও বলছেন তালিবান মন্ত্রীরা। নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বহরও কমেনি। তাই বেশিরভাগ দেশই তালিবানের ওপর ক্ষুব্ধ।
এদিকে অর্থনীতিবিদরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তার ওপর নির্ভরতা থেকে বের হয়ে অর্থনৈতিক ধস ঠেকিয়ে পরিস্থিতি উন্নয়নে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫৫
আপনার মতামত জানানঃ