কৃষ্ণসাগরে থাকা রাশিয়ার একটি ক্রুজার মোস্কভা (যুদ্ধজাহাজ) ডুবে গেছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় ঝড়ের কবলে পড়ে জাহাজটি ডুবে যায় বলে রাশিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। জাহাজটির ৫৪ জন নাবিককে উদ্ধার করেছে একটি তুর্কি জাহাজ।
এদিকে, ইউক্রেনের দাবি, তাদের জাহাজ বিধ্বংসী নেপচুন ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মস্কভার এই পরিণতি হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে, ইউক্রেনের দুটি নেপচুন ক্ষেপণাস্ত্রই মস্কভাতে আঘাত হেনেছে। ফলে সাগরেই সলীল সমাধি ঘটে রাশিয়ার কৃষ্ণসাগর ফ্লিটের ফ্ল্যাগশিপটির।
তবে ইউক্রেনের এই দাবির বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বলছে, যুদ্ধজাহাজ মস্কভা ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ
মিররের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম রুশিয়া ওয়ানের উপস্থাপক ওলগা স্কাবেয়েভা মস্কভা ডুবে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘ফলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলা যেতে পারে। এটি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ন্যাটোর প্রযুক্তির সঙ্গেই যুদ্ধ করছি। যদি ন্যাটো নাও হয়। আমাদের ন্যাটো হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।’
দ্য ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার (আইওডব্লিউ) বলছে, এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে ইউক্রেনের আঘাতেই মস্কভা ডুবেছে কি না। তবে মস্কভা হারানো সেটা যে কারণেই হোক না কেন, ইউক্রেনের প্রপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য এটি বড় বিজয়।
মস্কভা ডুবে যাওয়া রুশ নৌবাহিনীর আত্মবিশ্বাসেও চিড় ধরাবে। কিন্তু সামরিক বিবেচনায় মস্কভা ডুবে যাওয়ায় রাশিয়ার যুদ্ধ পরিকল্পনায় খুব একটা ব্যাঘাত ঘটার কথা নয়।
এই জাহাজটি ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকেই কৃষ্ণসাগরে মোতায়েন ছিল। আইওডব্লিউ বলছে, মস্কভা সম্ভবত ইউক্রেনের সামরিক সরঞ্জামকেন্দ্রগুলোতে ও বিমানঘাঁটিগুলোতে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে ব্যবহৃত হতো।
এ ধরনের হামলা খুব কাজে দিলেও বিমান হামলা কিংবা ভূমি থেকে নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় এর তাৎপর্য খুবই নগণ্য।
রাশিয়ার সামরিক বিশ্লেষক আলেক্সান্ডার খ্রামাচিখিন মস্কভা ডুবে যাওয়াকে মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি রয়টার্সকে বলেন, ‘জাহাজটি খুবই পুরোনো। প্রায় ৫ বছর আগে থেকেই একে অবসরে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল।
‘এর প্রকৃত সামরিক মূল্যের থেকেও এর সামগ্রিক মর্যাদা বেশি। স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান সামরিক অভিযানে এর খুব একটা ভূমিকা নেই। এটি ডুবে যাওয়াতেও অভিযানের কোনো প্রভাব পড়বে না।’
যদিও রাশিয়া শুরু থেকেই ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতিকে যুদ্ধ বলতে নারাজ। রাশিয়ার দাবি, ইউক্রেনকে অসামরিকায়ন ও নাৎসিমুক্তকরণের জন্য রুশ সেনারা বিশেষ সামরিক অভিযান চালাচ্ছে।
এ ছাড়া ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায় রাশিয়া। তবে ইউক্রেন বলছে, বিনা উসকানিতেই হামলা করেছে রাশিয়া।
এদিকে ১২ হাজার ৫০০ টনের আটলান্ট-ক্লাস মিসাইল ক্রুজার এই মস্কভা জাহাজটি রুশ নৌবাহিনীতে সার্ভিস দিয়ে আসছিল ১৯৭৯ সাল থেকে। এর মধ্যে রয়েছে ১৬টি অ্যান্টি-শিপ ক্ষেপণাস্ত্র, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, টর্পেডো ও গান। কৃষ্ণসাগরে মোতায়েন আটলান্ট-ক্লাসের এটিই একমাত্র জাহাজ। এ ছাড়া বাকি দুটি মিসাইল ফ্রিগেট ‘মার্শাল উসতিনভ’ ও ‘ভারইয়াগ’ রাশিয়ার নর্দান ও প্যাসিফিক ফ্লিটে মোতায়েন রয়েছে।
পারমাণবিক হামলার আশঙ্কা
ইউক্রেনে চলছে রুশ সামরিক অভিযান। পাল্টা প্রতিরোধ করছে ইউক্রেনীয় সেনারাও। এরই মধ্যে রুশ সেনারা দোনবাস অঞ্চলকে কেন্দ্র করে তাদের সামরিক পরিকল্পনা গুছিয়ে আনছে। ইউক্রেনও ন্যাটোভুক্ত দেশ থেকে ট্যাংক, এস-৩০০-এর মতো অস্ত্র পেয়েছে। সহসা সংঘাত থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
এর মধ্যে ইউক্রেনকে অস্ত্র দেয়ার বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আনুষ্ঠানিকভাবে সতর্ক করেছে রাশিয়া। এই আনুষ্ঠানিক সতর্কবার্তা কূটনৈতিক নোটের মাধ্যমে মস্কো থেকে এসেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলো নিশ্চিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে দুই পৃষ্ঠার একটি কূটনৈতিক নোট ওয়াশিংটনের রুশ দূতাবাস থেকে পাঠানো হয়েছে। সে নোটে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ইউক্রেন সংঘাতে অস্ত্র পাঠিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে, যা রাশিয়াকে ‘অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া’ দেখাতে বাধ্য করতে পারে।
সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার সম্ভাব্য পরমাণু হামলার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। বিশ্ববাসীকে এ বিষয়ে প্রস্তুত থাকা উচিত বলেও মনে করেন জেলেনস্কি।
পশ্চিমাদের নজিরবিহীন পরিণতির হুমকি
ইউক্রেনে চলছে রুশ সামরিক অভিযান। এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশ সেনা না পাঠালেও রাশিয়ার অভিযান শুরুর আগে থেকে প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র পাঠিয়ে আসছে ন্যাটো। সর্বশেষ ইউক্রেনে ট্যাংক ও এস-৩০০-এর মতো ভারী অস্ত্র পাঠালে বিষয়টিকে আর স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না ক্রেমলিন।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নতুন করে ইউক্রেনে ৮০০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সহায়তা অনুমোদন করে। যে সহায়তা প্যাকেজে প্রথমবারের মতো দীর্ঘপাল্লার কামান যুক্ত করা হয়, যা আক্রমণাত্মক অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত। বাইডেনের এই অনুমোদনের কয়েক ঘণ্টা পরই রাশিয়ার পক্ষ থেকে এই সতর্কবার্তা এলো।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যার পরিমাণ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোকেই নয়, রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে হামলা চালানোর জন্য সম্প্রতি ইউক্রেনকেও সতর্ক করেছে ক্রেমলিন। যদিও ইউক্রেন হামলার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। পশ্চিমাদের ধারণা, ইউক্রেনে বড় ধরনের কোনো হামলার প্রেক্ষাপট তৈরির চেষ্টা করছে রাশিয়া।
এদিকে বৃহস্পতিবার আটলান্টায় জর্জিয়া টেক ইউনিভার্সিটিতে এক বক্তৃতার সময় সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন ও রাশিয়ার নেতৃত্বের সম্ভাব্য হতাশার ফলে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিকে আমরা কেউই হাল্কাভাবে নিতে পারি না।
‘আমরা স্পষ্টতই খুবই উদ্বিগ্ন। আমি জানি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়ানোর বিষয় নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, যেখানে আপনি জানেন, পারমাণবিক সংঘাত সম্ভব।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৭০৫
আপনার মতামত জানানঃ