বাংলাদেশে অনিরাপদ সড়ক আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে৷ আর এজন্য এখন দায়ী করা হচ্ছে মোটরসাইকেলকে৷ ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অদক্ষ চালক ও সড়ক ব্যবস্থাপনার সংকট তো রয়েছেই৷ নিরাপদ সড়ক আইন কাগজে থাকলেও বাস্তবে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন৷
এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার শীর্ষ কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মোটরসাইকেল৷ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে মার্চে সারা দেশে ৫৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫৭৯ জন৷ এর মধ্যে শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটানাতেই মারা গেছেন ২২১ জন৷ শতকরা হিসাবে মার্চে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৩৭.৫২ ভাগই মারা গেছেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়৷
মটরসাইকেল যেভাবে মৃত্যুফাঁদ
সদ্য বিদায়ী ২০২১ সালে দেশে ৫৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬২৮৪ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২০৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২২১৪ জন। এদের মধ্যে ৭৪.৩৯ শতাংশ ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী। সড়ক দুর্ঘটনার এসব তথ্য উঠে আসে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে।
তিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৬.১৪ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ৫৪.৮১ শতাংশ। আর ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০.৪৭ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ৫১.৩৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়াদের মধ্যে ৭৪.৩৯ শতাংশ ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী।
২০২১ সালে জানুয়ারিতে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩১ লাখের বেশি, যা মোট যানবাহনের ৬৮ শতাংশ। শুধু ঢাকাতেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ৮ লাখের মতো। এর বাইরে একটি বড় অংশের মোটরসাইকেল অনিবন্ধিত। বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ৫ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার খবর সংকলন করে বুয়েটের এআরআই ও নিসচা। নিসচার হিসাবে, ২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ২৩২টি, যার ১ হাজার ১২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ ট্রাক ও ২২ শতাংশ বাস দুর্ঘটনার। বুয়েটের এআরআইয়ের হিসাবে, ২০১৬ সালে ২৮৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩৩৬ জন মারা যান। ২০২০ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৮টিতে, মারা যান ১ হাজার ৯৭ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০০৬ সালের একটি গবেষণা বলছে, ভালো মানের একটি হেলমেট পরলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হওয়ার ঝুঁকি কমে ৭০ শতাংশ। আর মৃত্যুঝুঁকি কমে ৪০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এই মৃত্যুর হার দিন দিন বাড়ছে৷ মোটরসাইকেল যারা চালান তাদের বড় একটি অংশ কিশোর-তরুণ৷ এরা বেপরোয়া, ট্রাফিক আইন জানে না বা মানে না৷ অনেকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই৷ যাদের আছে তারাও যোগ্য নয়৷
তারা নিজেরা যেমন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, তেমনি অন্যরা তাদের শিকারে পরিণত হচ্ছে৷ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই ১৪ ধেকে ৪০ বছর বয়সী৷
তিনি আরো বলেন, যানজটের কারণে মোটরসাইকেল ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে৷ গ্রামগঞ্জে এটা চালাতে লাইসেন্স লাগে না, হেলমেট লাগে না৷ অন্যান্য দেশে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করা হয়৷ আর আমাদের এখানে উৎসাহিত করা হয়৷ কিস্তিতেও মোটরসাইকেল পাওয়া যায়৷ কিন্তু এটা অন্যান্য যানবাহনের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ৷
একই ধরনের কথা বলেন নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রধান ইলিয়াস কাঞ্চন৷ তিনি বলেন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির মোটরসাইকেল আরোহী যে ছাত্রীটি কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় মারা গেলেন, তার পরিবারও তাকে মোটরসাইকেল (স্কুটি) চালাতে নিষেধ করেছিল৷ কিন্তু গণপরিবহণের সংকট ও ট্রাফিক জ্যামের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল চালাতে বাধ্য হচ্ছে৷ বিআরটিএ’র উচিত যারা চালাতে পারে তাদের লাইসেন্স দেয়া।
বিআরটিএর কাছে দেশে কত মোটরসাইকেল চলে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ তবে রেজিস্টার্ড মোটরসাইকেল হিসাব আছে বলে জানান বিআরটিএর রোড সেফটি বিভাগের পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব ই রাব্বানী৷ তিনি বলেন, মোটরসাইকেল মানুষ এখন বেশি ব্যবহার করছে, তাই দুর্ঘটনাও বেশি ঘটছে৷ মোটরসাইকেলে মুভমেন্ট বেড়ে গেছে।
দুর্ঘটনা এড়াতে সবচেয়ে জরুরি হলো আইন মেনে চলা। মোটরযান আইনের যেসব বিষয় রয়েছে সেসব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করতে হবে চালক ও যাত্রীকে। মনে রাখবেন, আইন অমান্য করলে জরিমানা দিয়ে হয়ত রেহাই পাওয়া যায় কিন্তু দুর্ঘটনা হলে চূড়ান্ত ক্ষতি আপনার। আইন মানা ও কিছু বিষয়ে সচেতন থাকলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা অনেকটাই এড়ানো সম্ভব।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কী করে এড়াবেন
অদক্ষদের মোটরসাইকেল চালাতে দেবেন না: সাধারণত ঈদ বা কোনো উৎসবের সময় দেখা যায় মোটরসাইকেল ধার নেন বন্ধু-বান্ধব, নিকট আত্মীয়, সহপাঠী, সহকর্মী বা প্রতিবেশীরা। তাদের হাতে মোটরসাইকেল তুলে দেবেন না। যদিও লাইসেন্স ছাড়া কেউ মোটরসাইকেল চালাতে পারবেন না, তবে বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের তুলনায় চালকের লাইসেন্স অর্ধেকেরও কম। সাধারণত দেখা যায় একটি মোটরসাইকেল পরিবারের বা কোনো অফিসের একাধিক সদস্য ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রে অদক্ষ চালকের হাতে মোটরসাইকেল পড়ার সম্ভাবনা বেশি। এ বিষয়ে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।
মোটরসাইকেল কেনার আগে অবশ্যই প্রশিক্ষণ নিতে হবে এবং লাইসেন্স করতে হবে। লাইসেন্স ছাড়া যান্ত্রিক পরিবহণ চালানো আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
যাত্রা শুরুর আগে মোটরসাইকেল নিরাপদ কি না পরীক্ষা করুণ: মোটরসাইকেলে যাত্রা শুরুর আগে কিছু যান্ত্রিক বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন। তেল, ব্রেক, লাইট, হর্ন ইত্যাদি কাজ করছে কি না পরীক্ষা করুণ। এছাড়া ফিটনেসবিহীন মোটরসাইকেল চালাবেন না। ফিটনেস ও লাইসেন্স না থাকলে সড়কে মোটরসাইকেলটি অবৈধ। লাইসেন্সবিহীন পরিবহণ চালানো আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
পরতে হবে হেলমেট-গ্লাভস-ফুল প্যান্ট-জুতা: মোটরসাইকেলে যাত্রা শুরুর আগে অবশ্যই আইন মেনে পোশাক পরিধান করতে হবে। পরতে হবে হেলমেট, গ্লাভস, জুতা ও ফুল প্যান্ট। মোটরযান আইন ১৯৮৮ (সংশোধনী) অনুসারে, চালক ও যাত্রী দু’জনের মাথায় অবশ্যই হেলমেট থাকতে হবে। এ ছাড়া হাতে গ্লাভস ও পায়ে জুতা পরে তবেই চালকের আসনে বসতে হবে। মনে রাখতে হবে, হেলমেট ও হ্যান্ডস গ্লাভসই দুর্ঘটনায় আপনাকে বড় ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে। বাংলাদেশে দেখা যায় অনেকেই লুঙ্গি পরে মোটরসাইকেল চালান। এটি নিরাপদ নয়। পরতে হবে ফুল প্যান্ট, পায়ে থাকতে হবে জুতা।
মহাসড়কে দূরের যাত্রা মোটরসাইকেলে নয়: মহাসড়কে দূরের যাত্রায় মোটরসাইকেল মোটেও নিরাপদ নয়। দূরের যাত্রা উপযোগী হিসেবে তৈরি করা হয়নি এ বাহন। এ বাহনটি দিয়ে স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে ভ্রমণ করাই শ্রেয়। মহাসড়কে দূরের যাত্রা পুরপুরি পরিহার করুণ। যেসব মহাসড়কে দুই চাকার যান চলাচল নিষিদ্ধ সেসব মহাসড়কে উঠবেন না। দূরের যাত্রায় মোটরসাইকেল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বাহন। এটি নিশ্চিতভাবেই মরণ ফাঁদ।
দুইয়ের অধিক নয়: মোটরসাইকেলে চালকসহ দুই জন একসঙ্গে ভ্রমণ করতে পারবেন। একটি মোটরসাইকেলে দুই জনের বেশি আরহী বেআইনি। আমাদের দেশে দেখা যায়, মোটরসাইকেলে জায়গা থাকায় প্রায়ই তিন জন আরোহী ভ্রমণ করেন যা একইসঙ্গে বেআইনি ও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। মনে রাখবেন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়াররা মোটরসাইকেল এমনভাবে নকশা করেছেন যেন একসঙ্গে দুই জন চলতে পারেন। তাই এক মোটরসাইকেলে তিন জন চড়লে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক অনেক গুণ বেড়ে যায়।
গতি রাখুন সীমিত: মনে রাখবেন বেশিরভাগ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বেপরোয়া গতি। উচ্চ গতিতে গাড়ি বা মোটরসাইকেল চালানোকে অনেকেই নিজের দক্ষতার প্রমাণ বলে মনে করেন। আসলে তা অদক্ষতাই তুলে ধরে। কারণ অদক্ষ চালক মাত্রই যথাযথ গতিসীমা জ্ঞানশূন্য। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লাইসেন্সধারী দক্ষ চালক কখনই যথাযথ গতির উপরে গাড়ি চালাবেন না। দুর্ঘটনা এড়াতে গতি সীমিত রেখার কোনো বিকল্প নেই। নিয়ন্ত্রণের বাইরে গতিতে মোটরসাইকেল চালাবেন না। নিজের ও অন্যের জীবন ঝুঁকিতে ফেলবেন না। সড়কে স্পিডব্রেকারে প্রায়ই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। এর একমাত্র কারণ দ্রুত গতি।
সড়কে প্রতিযোগিতা নয়: একটি মোটরসাইকেল অভারটেক করলেই দুই মোটরসাইকেলে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। অদক্ষ ও অপরিণামদর্শী চালকরাই মূলত এ ধরণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে থাকেন। কোনো গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেও কোনো ধরণের প্রতিযোগিতা ঠিক করবেন।
এছাড়া আরেক ধরণের প্রতিযোগিতা দেখা যায়, কে কত কায়দা করে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। কেউ কেউ দুই হাত ছেড়ে চালানোর চেষ্টা করেন, কেউ আবার সড়কে জিগজ্যাগ চালান। এসবই অদক্ষতার চরম বহিঃপ্রকাশ। সড়কে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলে আপনারসহ সড়কে অন্যান্য পরিবহণের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। এ ধরণের মানসিকতা অবশ্যই বর্জনীয়।
বাঁকে বিপদ: বাঁক নেওয়ার সময় বিপদ ঘটে। এসময় গতি কমাতে হবে। গতি বেশি থাকলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া এ সময় উল্টোদিক থেকে আসা গাড়ি খেয়াল রাখতে হবে খুব সতর্কতার সঙ্গে। প্রয়োজনে ভেপু বাজান। উল্টোদিক থেকে কী আসছে বা কী আছে তা পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে এগোবেন না।
দুই রাস্তার সংযোগস্থলে অধিক ঝুঁকি: দুই বা একাধিক রাস্তার সংযোগস্থল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বেশিরভাগ দুর্ঘটনা এসব জায়গায়ই হয়ে থাকে। শহরের বাইরে যেসব সড়কে ট্রাফিক পুলিশ নেই সেখানে খুবই সতর্ক হতে হবে। কেননা আপনি সঠিক নিয়ম পালন করলেও দেখা যাবে আরেক গাড়ির নিয়ম ভাঙার ফল ভোগ করতে হতে পারে আপনাকে। তাই খেয়াল রাখুন অন্য রাস্তায় গাড়ির গতিবিধি।
খারাপ আবহাওয়ায় মোটরসাইকেল নয়: মোটরসাইকেল খারাপ আবহাওয়া উপযোগী বাহন নয়। তাই আবহাওয়া খারাপ থাকলে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হবেন না। ঝড়-বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা, তুষারপাতের সময় মোটরসাইকেল নয়। মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলে যদি বৃষ্টি বা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে তবে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিন। এ সময় মোটরসাইকেল চালাবেন না। দ্রুত বাড়ি ফিরতে গিয়েও দুর্ঘটনা ঘটে। আশেপাশের নিরাপদ জায়গায়ই আশ্রয় নিন। দূরের গন্তব্যে আশ্রয় নিতে গতি বাড়াবেন না।
সড়কে বালি, পাথর, কাঁদায় ঘটে দুর্ঘটনা: অনেক সতর্কতার পরেও বালি, পাথর ও কাঁদায় ঘটে দুর্ঘটনা। শুকনো বালি বা পাথর রাস্তায় বেশি পরিমাণে থাকলে এতে চাকা স্লিপ করবে। তাই সড়কের বালি ও পাথরপূর্ণ অংশে মোটরসাইকেল চালাবেন না। এছাড়া রাস্তায় কাঁদা জমে গেলেও চাকা স্লিপ করে। ঘটে বিপদ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ