সমুদ্র, নদী, পাহাড়ের মেলবন্ধন রয়েছে চট্টগ্রামে। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যের নগরীর পাহাড়গুলো একে একে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী ভূমিপুত্রদের কুনজরে হারিয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ পাহাড়। কেউ কাটছে কৌশলে, কেউ কাটছে দিনদুপুরে কিংবা রাতে। চট্টগ্রাম নগরীতে এ ধরনের অসংখ্য পাহাড়ের একটি বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার পাহাড়। পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা করে দায় সারলেও ঠেকানো যাচ্ছে না পাহাড় কাটা। আবার ধসে পড়া মাটিও রাতের আঁধারে সরিয়ে নেয় প্রভাবশালী এবং দুষ্কৃতকারীরা। এভাবে পাহাড়ের আশেপাশে পাহাড়ি ভূমিতে তৈরি হচ্ছে একে একে অট্টালিকা।
এদিকে চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ লিংক রোডে পাহাড় কেটে প্রাচীর দেওয়ার অভিযোগে নুর উদ্দিন নামের এক গার্মেন্টস কারখানা মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। সোমবার (১৪ মার্চ) বিকেলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিদর্শক মনির হোসেন বাদী হয়ে নগরীর আকবর শাহ থানায় মামলাটি দায়ের করেন।
মামলায় অবৈধভাবে পাহাড়, টিলা কর্তন করায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত-২০১০) এর ৬(খ) ধারায় অভিযোগ করা হয়। আসামি নুর উদ্দিন চট্টগ্রামের মীরসরাই থানাধীন পশ্চিম মলিয়াইশ গ্রামের মৃত মোহাম্মদ শামুল আলমের ছেলে। তিনি নাস অ্যাপারেলস লিমিটেড নামের একটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
জানা যায়, শুষ্ক মৌসুমের সুবিধা কাজে লাগিয়ে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড সংলগ্ন অসংখ্য পাহাড়কে ন্যাড়া করে দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে প্রভাবশালী ও ভূমিদস্যুরা। ইতোমধ্যে সড়কটির আশপাশের অনেক পাহাড় কেটে আরসিসি পিলার দিয়ে সীমানা প্রাচীর দেওয়া হচ্ছে। আবার টিনের ঘেরাও দিয়ে কৌশলে সবুজ পাহাড় কাটা হচ্ছে। কোথাও কোথাও বৃক্ষরোপণ অভিযানে, বৃক্ষ প্রকল্প সাইনবোর্ড ঝুলিয়েও পাহাড় কাটা ও দখলের প্রতিযোগিতা শুরু করেছে প্রভাবশালীরা।
গণমাধ্যমে প্রচারিত নানান প্রতিবেদনের সূত্র ধরে গত ৬ মার্চ বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডে এনফোর্সমেন্ট পরিচালনা করে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের একটি টিম। এতে পাহাড় কাটার অভিযোগ পেয়ে বেশ কয়েকজনকে নোটিশ দিয়ে শুনানিতে ডাকা হয়। তার মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে পাহাড় কেটে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করার অভিযোগে ১৩ মার্চ ব্যবসায়ী নুর উদ্দিনকে শুনানিতে ডাকা হয়।
চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ লিংক রোডে পাহাড় কেটে প্রাচীর দেওয়ার অভিযোগে নুর উদ্দিন নামের এক গার্মেন্টস কারখানা মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা গেছে, আসামি নুর উদ্দিন একই এলাকার একটি প্রাকৃতিক ছড়ার ৮০ শতাংশ ভূমি দখল করে দেয়াল নির্মাণ করেছেন। এর পাশে বায়েজিদ লিংক রোডের ৬ নম্বর ব্রিজটি অবস্থিত। তাই ছড়াটি ওই এলাকার পানি নিষ্কাশনের পথ বলে মনে হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে। ছড়ার জায়গায় দেয়াল নির্মাণের ফলে ওই খালের পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে উক্ত এলাকায় জলাবদ্ধতা হাতে পারে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতামত চাওয়া হবে। তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে পরিবেশ অধিদপ্তর।
সোমবার তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন অধিদপ্তরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস। এরপর সোমবার বিকেলে আকবর শাহ থানায় লিখিত এজাদার দায়ের করেন কার্যালয়ের পরিদর্শক মনির হোসেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের লিখিত এজাহারটি থানায় মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়।
হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, গত ৬ তারিখ ঘটনাস্থল বায়েজিদের লিংক রোড পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনে পাহাড় কেটে রিটেইনিং দেয়াল নির্মাণের প্রমাণ পাওয়া যায়। গত ১৩ মার্চ এ বিষয়ে শুনানি হয়। এতে আসামি নুর উদ্দিনের পক্ষে আবদুল হক উপস্থিত ছিলেন। শুনানি শেষে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার আদেশ দিয়েছি। সোমবার পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. মনির হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
এ বিষয়ে আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জহির হোসেন বলেন, পাহাড় কাটার অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে লিখিত অভিযোগ পেয়ে মামলা নেওয়া হয়েছে। আসামির বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
২০১১ সালে চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা নিয়ে ‘হিল কাটিং ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বেশিরভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝর্ণা, ষোলশহর এবং ফয়’স লেকে।
১৯৭৬ থেকে ৩২ বছরে চট্টগ্রাম নগর ও আশেপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ১৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ০২ বর্গকিলোমিটার। এ সময় ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়। এটা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। নগরের বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, চট্টগ্রাম এলাকায় বর্ষাকালে প্রাণঘাতী ভূমিধস ও কাদার প্রবাহ নেমে আসার প্রধানতম কারণ হলো পাহাড় কাটা। এর বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগের বিষয়ে ঔদাসীন্য রয়েছে। এ ঔদাসীন্য কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন।
তারা বলেন, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য পাহাড়। কিন্তু প্রশাসন ও বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়হীনতার কারণে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো দিন দিন দখলে গিয়ে বিলাসবহুল প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। কেউ দখল করে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ভাড়া দিচ্ছে। আবার কেউ আবাসন প্রকল্পের নামে পাহাড় কেটে সুউচ্চ আবাসন ভবন তৈরি করে চড়া দামে বিক্রি করছে।
এ পাহাড়ের ওপর প্রকল্পগুলোর নকশা সিডিএ কিভাবে অনুমোদন দেয়, সেটাই অন্ধকারে রয়ে গেছে। নগরীর সৌন্দর্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পাহাড় সংরক্ষণ করা জরুরি।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পাহাড় ও বন কাটার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বা পরিবেশ আদালতে মামলা করেই যেন পরিবেশ অধিদপ্তর দায়িত্ব শেষ। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং পাহাড় ধ্বংসকারীদের আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। জরিমানা ছাড়াও পাহাড় বেষ্টনী দিয়ে বনায়ন করতে হবে।
তারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, সেগুলোতে একই অপরাধ বারবার হলে শাস্তির মাত্রা কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পরিবেশ আইনে যদি এমন দুর্বলতা থাকে, তাহলে তা দূর করা এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ দ্রুতই পাহাড়শূন্য হয়ে যাবে, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল বলে কিছু থাকবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৮
আপনার মতামত জানানঃ