১৯৬২ সালের ২৫শে অক্টোবর মধ্যরাতে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনের রানওয়ের দিকে দ্রুতগতিতে যাচ্ছিলো একটি ট্রাক। এটা ছিলো একটি বিমানের উড্ডয়ন আটকে দেয়ার আগ মুহূর্তের ঘটনা। কয়েক মিনিট আগে ডুলুথ সেক্টর ডিরেকশন সেন্টারের একটি গার্ড ছায়াসদৃশ কিছু একটাকে ওই কেন্দ্রের সীমানা প্রাচীর বেয়ে উঠতে দেখেন। তিনি সেটিকে লক্ষ্য করে গুলি করেন এবং সতর্কবার্তা জারি করেন এই ভয়ে যে হয়তো এটা সোভিয়েত হামলার একটি অংশ। সাথে সাথে ওই এলাকার সব বিমান ঘাঁটিতে এ সতর্কতা জারি করা হয়।
পরিস্থিতি দ্রুতই আরও জটিল হয়ে ওঠে। নিকটবর্তী বিমান ঘাঁটি ভল্ক ফিল্ডে কেউ একজন ভুল সুইচ চেপে দেন। ফলে সাধারণ নিরাপত্তা সতর্কবার্তার পরিবর্তে পাইলটদের কানে বেজে ওঠে জরুরি সাইরেন। মুহূর্তেই পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত বিমানগুলো একযোগে উড্ডয়নের উদ্যোগ নেয়। একেবারে হুড়োহুড়ি পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা। এটা ছিলো কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সময়কার কথা। এর এগারো দিন আগে একটি গোয়েন্দা উড়োজাহাজ থেকে কিউবার মিসাইল, ট্রাক ও গোপন লঞ্চারের ছবি তোলা হয়। যা দেখে মনে করা হয় যে সোভিয়েত পুরো যুক্তরাষ্ট্রে তাদের টার্গেটগুলোকে কেন্দ্র করে গুছাচ্ছিলো। তবে পুরো বিশ্বই জানতো যে কোন পক্ষ থেকে একটি হামলা নজিরবিহীন অবনতি ঘটাতো।
কিন্তু এসব যখন ঘটছে তখন জানা যায় এগুলোর সাথে জড়িত কোন মানুষ নয় বরং ওই সীমানা প্রাচীরের কাছে ছায়া পড়েছিলো একটি বড় কালো ভালুকের। অর্থাৎ পুরোটাই ছিলো একটা ভুল। তবে ভল্ক ফিল্ডে তখনো এ সত্য পৌঁছায়নি। বরং তারা পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলো যে – তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শেষ পর্যায়ে বিমান ঘাঁটির কমান্ডার বের করেন যে আসলে কি হয়েছিলো। তিনিই একটি ট্রাক নিয়ে গিয়ে পাইলটদের থামান।
এটা ভুলে যাওয়া সহজ যে প্রায় ১৪ হাজার পারমানবিক অস্ত্র রয়েছে এই দুনিয়া যা দুনিয়ার তিনশো কোটি মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে, এমনকি মানবজাতিকে বিলুপ্তও করে দিতে পারে। আমরা জানি এর কোনটি যদি কোন নেতা ইচ্ছা করে বিস্ফোরণ ঘটাতে চান তাহলে তিনি বা তারা আসলে পাগল। কিন্তু আমরা যেটি ধারণা করতে পারি না তা হলো এটি আসলে দুর্ঘটনাক্রমেও হতে পারে। এ পর্যন্ত অন্তত ২২ বার এমনটি ঘটতে যাচ্ছিলো যা শেষ পর্যন্ত অল্পের জন্য আর হয়নি। আর যেসব বিষয় এভাবে বিশ্বকে পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলো তার মধ্যে ছিলো একদল রাজহাঁস, চাঁদ, সামান্য কম্পিউটার সমস্যা এবং মহাকাশের অস্বাভাবিক আবহাওয়া।
১৯৫৮ সালে একটি বিমান থেকে ভুলবশত একটি বাড়ির বাগানে পারমানবিক বোমা ফেলা হয় কিন্তু বিস্ময়করভাবে কেউ মারা যায়নি। তবে কিছু মুরগি পুড়ে যায় তাপে। ২০১০ সালে আরেক বিপর্যয় তৈরি হয় যখন মার্কিন বিমান বাহিনী অন্তত ৫০টি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলে। এর মানে হলো ওই সময়ে এগুলো চিহ্নিত করা কিংবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হওয়া ঠেকানোর সুযোগ ছিলো না। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপক আধুনিকায়ন সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এ খাতে ২০১৯ থেকে পরবর্তী আট বছরে অন্তত ৪৯৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। যদিও ইতিহাস বলছে মানবিক ভুল বা উৎসাহীর বন্যপ্রাণী কারণে কিভাবে এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা হুমকিতে পড়তে পারে।
১৯৯৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি তখনকার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলিৎসিন প্রথম বিশ্বনেতা হিসেবে নিজের ‘নিউক্লিয়ার ব্রিফকেস’ সক্রিয় করেছিলেন। এ ব্রিফকেসেই পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য নির্দেশনা ও প্রযুক্তি থাকে। ইয়েলেৎসিনের রাডার অপারেটর খেয়াল করেছিলেন যে একটি রকেট নিক্ষেপ হয়েছে নরওয়ে উপকূল থেকে এবং তারা দেখেন যে এটি অস্বাভাবিকভাবে আকাশের দিকে উঠছে। ব্রিফকেস হাতে নিয়েই মিস্টার ইয়েলিৎসিন তার উপদেষ্টাদের সাথে পাল্টা হামলা নিয়ে আলোচনায় বসেন। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে তারা বুঝতে পারেন যে এটি সাগরের দিকেই গেছে এবং এটি কোন হুমকি ছিলো না। পরে জানা যায় এটি কোন পারমাণবিক হামলা ছিলো না। তবে ভিন্ন একটি গবেষণার অংশ ছিলো সেটি। তবে বিষয়টি নরওয়ের কর্মকর্তাদের অবাক করেছিলো, কারণ তারা এক মাস আগেই এ সম্পর্কিত ঘোষণা দিয়েছিলো।
ফলস অ্যালার্মের জন্য দুটি ভুল দায়ী হতে পারে – প্রযুক্তিগত ও মানবিক। এ দুটি একসাথেও হতে পারে। এমন ঘটনা ঘটেছিলো ১৯৮০ সালে। মিস্টার পেরি তখন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সাথে কাজ করছিলেন। একটি তিন মিনিটের কল থেকে এর সূচনা হয়েছিলো। এয়ার ডিফেন্স কমান্ড থেকে তাকে জানানো হয়েছিলো যে নজরদারিতে থাকা একটি কম্পিউটার আবিষ্কার করেছে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দুশো মিসাইল সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রর দিকে আসছে।
কিন্তু এর মধ্যেই তারা বুঝতে পারেন যে এটি সত্যিকারের হুমকি নয়। কম্পিউটার কোনোভাবে এ ভুল তথ্যটি পেয়েছে। “আমাকে কল দেয়ার আগে তারা হোয়াইট হাউজে কল দিয়েছিলো। নিরাপত্তা উপদেষ্টার মাধ্যমে তারা প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলেছিলো,” বলছিলেন মিস্টার পেরি। ভাগ্য ভালো প্রেসিডেন্টকে জাগানোর আগে তিনি কয়েক মিনিট সময় নিয়েছিলেন। যদি তারা জিমি কার্টারকে তখনি জাগাতে পারতেন তাহলে এখনকার বিশ্ব হয়তো ভিন্ন কিছু হতো। ওই ঘটনার মূলে ছিলো একটি ত্রুটিমুক্ত কম্পিউটার চিপ। পরে তা পরিবর্তন করা হয়।
এক বছর আগে আরও একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিলো পেরির যখন একজন টেকনিশিয়ান ভুলে একটি প্রশিক্ষণ টেপ কম্পিউটারে আপলোড করে ফেলেন। এট ভুলে প্রধান সতর্কীকরণ কেন্দ্র ক্ষেপণাস্ত্র হামলার তথ্য দিয়েছিলো। পেরি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পারমাণবিক অস্ত্র হামলার পূর্ণ কর্তৃত্ব আছে এবং একমাত্র তিনিই সেটি করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের সময় থেকেই এটি হয়ে আসছে। তিনি বিশ্বাস করতেন পারমাণবিক অস্ত্র একটি রাজনৈতিক উপকরণ এবং সে কারণেই এটি রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিৎ। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেখানেই যেতেন তার একজন সহকারী ‘নিউক্লিয়ার ফুটবল’ বহন করতেন যেখানে হামলা করার জন্য কোড দেয়া ছিলো। সুতরাং পর্বতারোহণ করেন আর ভ্রমণেই থাকুন কিংবা হেলিকপ্টার হোক বা সাগরে হোক মিস্টার ট্রাম্প এ হামলা চালানোর সক্ষমতা ছিলো। যদিও অনেক সংস্থা ও বিশ্লেষক বলেছেন এভাবে একজন ব্যক্তির কাছে ক্ষমতা রাখাটা বিরাট ঝুঁকির কাজ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ