ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, হাঙ্গেরিভিত্তিক উদ্যোক্তা জুলকারনাইন সায়ের খান ওরফে সামিসহ সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন আদালত। রোববার দুপুরে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এ অভিযোগ গঠন করেন।
এসময় পরপর দুটি শুনানির তারিখে অনুপস্থিত থাকায় কিশোরের জামিন বাতিল করেন ট্রাইব্যুনাল এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেন।
সূত্র মতে, আগামী ৭ এপ্রিল সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ঠিক করেছেন আদালত। বাকি পাঁচজন হলেন, সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান, রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া, আশিক ইমরান ও স্বপন ওয়াহিদ।
মিনহাজ ও দিদারুল জামিনে আছেন। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ পড়ে শোনালে তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। কিশোরসহ বাকি পাঁচজন বর্তমানে পলাতক।
এ দিন মিনহাজ ও দিদারুল অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে পৃথক আবেদন করেন। শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল আবেদন খারিজ করে দেন।
গতবছরের ১২ সেপ্টেম্বর কিশোরসহ সাতজনের বিরুদ্ধে পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন আদালত। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের উপ-পরিদর্শক মো. আফছার আহমেদ ১৩ জুন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ অভিযোগপত্র জমা দিয়েছিলেন।
গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। তাতে কার্টুনিস্ট কিশোর, লেখক মুশতাক আহমেদ ও রাষ্ট্রচিন্তার দিদারুল ভূঁইয়াকে আসামি করা হয় এবং আটজনকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়।
এরপর ২৫ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দী মুশতাক আহমেদ মারা যান। এ কারণে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। তবে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ মামলা অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল।
তাদের বিরুদ্ধে যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মহামারি করোনাভাইরাস সম্পর্কে গুজব, রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে অপপ্রচার এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়। মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, তাঁরা রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপরাধ করেছেন।
২০২০ সালের ৬ মে র্যা ব-৩ এর সহকারী পরিচালক আবু বকর সিদ্দিক ১১ জনকে আসামি করে রমনা থাকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেছিলেন।
নির্মম নির্যাতনের শিকার কিশোর
কার্টুন আঁকার অপরাধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে ৩০০ দিন কারাবন্দি থাকার পর গত ৩ মার্চ কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত। পরদিন ৪ মার্চ তিনি কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান।
কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর গত ১০ মার্চ আদালতে হাজির হয়ে হেফাজতে থাকাকালে নির্যাতনের শিকার হওয়ার বর্ণনা দেন কিশোর।
কিশোর জানান, গত ৫ মে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হলেও ২ মে আনুমানিক পৌনে ৬টার সময় ১৬ থেকে ১৭ জন সাদা পোশাকধারী লোক তাকে কাকরাইলের বাসা থেকে জোর করে হাতকড়াসহ মুখোশ পরিয়ে অচেনা নির্জন জায়গায় নিয়ে যায়। করোনা নিয়ে তার আঁকা কিছু কার্টুন দেখিয়ে কেন এঁকেছে এবং কার্টুনের চরিত্রগুলো কারা প্রশ্ন করা হয়।
তিনি বলেন, ‘এক পর্যায়ে প্রচণ্ড জোরে আমার কানে থাপ্পর মারে। কিছুক্ষণের জন্যে আমি বোধশক্তিহীন হয়ে পড়ি। বুঝতে পারছিলাম আমার কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তারপর স্টিলের পাত বসানো লাঠি দিয়ে পায়ে পেটাতে থাকে। যন্ত্রণা ও ব্যথায় সজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলাম। বর্তমানে আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ, কান দিয়ে পুঁজ পড়ে, হাঁটতে পারি না, হঠাৎ করে পড়ে যাই। এবং শরীরে আরও নানাবিধ রোগের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেশের সচেতন নাগরিকদের জন্য প্রতিনিয়ত আরও বড় হুমকির কারণ হয়ে উঠছে। কিশোরের মতো একজন কার্টুনিস্ট, যিনি দেশের সাধারণ মানুষের অধিকারের জন্য রাষ্ট্রের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে চান, আজ তিনি আইনের হাতে বন্দি। শুধু কিশোর নন, এই আইনে ভুক্তভোগী দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর প্রায় প্রত্যেকেই। আর এর প্রতিপক্ষ স্বাধীনতা নিয়ে গর্ব করা আওয়ামী লীগ নিজেই।
তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিক্যাল নাইনটিন বলছে, ২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কটূক্তির কারণে।
সরকারি দলের এসব নেতাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীরা ছাড়ারও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতো সংগঠনের নেতারাও রয়েছেন, যাদের নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হয়েছে।
আর্টিকেল নাইনটিন বলছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া ২২৫টি মামলায় বিভিন্ন শ্রেণী -পেশার ৪১৭ জন ব্যক্তি অভিযুক্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ৬৮ জন সাংবাদিকও আছে। এসময় ১৫ জন সাংবাদিক এই আইনের আওতায় গ্রেপ্তার হয়েছেন।
আর মামলাগুলো দায়েরের পরপরই বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে ১৬৬জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯০টির মতো মামলা হয়েছে শুধু ক্ষমতাশালীদের কটূক্তির অভিযোগে। এটি প্রমাণ করে যে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে অপব্যবহার করছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ