গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা কিছু হালকা কথাবার্তা ও বিএনপির ওপর লবিংয়ের দায় চাপিয়ে পার করতে চাইছেন। তবে সম্প্রতি জানা গেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বিশ্বের ২৪টি দেশের তিন শতাধিক গুমের ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওই আলোচনায় বাংলাদেশে গুমের বেশ কিছু অভিযোগ নিয়েও ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্যরা কথা বলেছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের ১২৬তম অধিবেশন শেষ হয়েছে গত শুক্রবার। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ৭ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী ওই অধিবেশন আয়োজন করা হয়েছিল।
গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, অধিবেশন চলার সময় ওয়ার্কিং গ্রুপ ১৭টি গুমের অভিযোগ খতিয়ে দেখেছে। ওয়ার্কিং গ্রুপ ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে জরুরি পদক্ষেপমূলক প্রক্রিয়ার আওতায় এসব অভিযোগের প্রতিকার চেয়ে সংশ্লিষ্ট দেশকে জানিয়েছিল। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে আজারবাইজান, মিসর, কেনিয়া, লেবানন, লিবিয়া, পাকিস্তান, রাশিয়ান ফেডারেশন ও সৌদি আরব রয়েছে।
ছাড়া ওই অধিবেশনে ওয়ার্কিং গ্রুপ গুমের আরও ৭২৭টি অভিযোগ নিয়ে পর্যালোচনা করেছে। তার মধ্যে জরুরি পদক্ষেপমূলক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়া নতুন গুমের অভিযোগের পাশাপাশি পূর্ববর্তী বিষয়ের হালনাগাদ করা তথ্য রয়েছে।
এসব অভিযোগের তালিকায় বাংলাদেশের নামও রয়েছে। অন্য দেশগুলো হলো আলজেরিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, চীন, কলম্বিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইকুয়েডর, মিসর, এল সালভাদর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, লাটভিয়া, লেবানন, লিবিয়া, পাকিস্তান, রুয়ান্ডা, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, সিরিয়া, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভেনেজুয়েলা।
এসব গুমের অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের কাছে চিঠি দিয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছিল ওয়ার্কিং কমিটি। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার যে জবাব দিয়েছে, সেগুলো নিয়েও ওয়ার্কিং গ্রুপের অধিবেশনে আলোচনা হয়েছে। অধিবেশনে নতুন কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে, ইউক্রেন সফর নিয়ে যে সুপারিশগুলো করা হয়েছে তার ফলোআপ প্রতিবেদন তৈরি, নতুন প্রযুক্তি ও গুম নিয়ে বিষয়ভিত্তিক নতুন প্রতিবেদন তৈরি এবং গুম থেকে সব ব্যক্তিকে সুরক্ষাসংক্রান্ত ঘোষণা ১৯৯২ এর ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে একটি মূল্যায়নভিত্তিক গবেষণা করা।
অধিবেশন চলার সময় ওয়ার্কিং গ্রুপ ১৭টি গুমের অভিযোগ খতিয়ে দেখেছে। ওয়ার্কিং গ্রুপ ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে জরুরি পদক্ষেপমূলক প্রক্রিয়ার আওতায় এসব অভিযোগের প্রতিকার চেয়ে সংশ্লিষ্ট দেশকে জানিয়েছিল। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে আজারবাইজান, মিসর, কেনিয়া, লেবানন, লিবিয়া, পাকিস্তান, রাশিয়ান ফেডারেশন ও সৌদি আরব রয়েছে।
ওয়ার্কিং গ্রুপের অধিবেশনে ২০২২ সালে সাইপ্রাস ও কেনিয়াসহ কয়েকটি দেশে সফর করার সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
মানবিক নীতিবোধের জায়গা থেকে ওয়ার্কিং গ্রুপ বিভিন্ন দেশে সরকার–বহির্ভূত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গুমের সমতুল্য কর্মকাণ্ড নথিবদ্ধ করা এবং তা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইয়েমেনের সানা কর্তৃপক্ষকে এমন তিনটি বিষয় অবহিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওয়ার্কিং গ্রুপ। বিভিন্ন সূত্রের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ ঘটনাগুলো নথিভুক্ত করেছে তারা।
ওয়ার্কিং গ্রুপের বিশেষজ্ঞরা গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজন, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আগামী ৯ থেকে ১৩ মে গ্রুপের ১২৭তম অধিবেশন বসবে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের পাঁচজন স্বাধীন বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত। বর্তমানে এ গ্রুপে চেয়ারপারসন আর্জেন্টিনার লুসিয়ানো হাজান এবং ভাইস চেয়ারপারসন গিনি বিসাউয়ের আউয়া বাউজে। অন্য সদস্যরা হলেন ইতালির গ্যাব্রিয়েলা চিত্রনি, লিথুনিয়ার হেনরিকাস মিকেভিসিয়াস এবং দক্ষিণ কোরিয়ার তায়ে উং বাইক।
১৯৮০ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মানবাধিকার কমিশন এই ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করেছিল। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিণতি কী হয়েছে, তারা কোথায় আছেন, সে ব্যাপারে জানতে তাদের পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতার লক্ষ্যে গ্রুপটি গড়ে তোলা হয়েছিল। গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবার ও সংশ্লিষ্ট সরকারের মধ্যে যোগাযোগের পথ তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা করে তারা। এর মধ্য দিয়ে প্রতিটি গুমের ঘটনার তদন্ত নিশ্চিত করা এবং গুম হওয়া ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নিশ্চিতের চেষ্টা করা হয়। গুমের ঘটনা থেকে সব ব্যক্তিকে সুরক্ষা দেওয়া–সংক্রান্ত জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নে দেশগুলোকে সহযোগিতাও করে থাকে এ ওয়ার্কিং গ্রুপ।
জাতিসংঘের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের এক নথিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গুমের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। কয়েক বছর ধরে এ নিয়ে উদ্বেগ জানালেও বাংলাদেশ কোনো সাড়া দিচ্ছে না। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের কাছে গুমের বেশ কিছু অভিযোগ নিয়ে জানানো হলেও সেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
১৯৯৬ সাল থেকে ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে। বাংলাদেশ কেবল একটি গুমের অভিযোগের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। ওয়ার্কিং গ্রুপ অমীমাংসিত বাকি অভিযোগের বিষয়ে শিগগির জবাব দেবে বলে আশা করে। বাংলাদেশে গুমের ক্ষেত্রে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এগুলো দ্রুত তদন্ত করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া উচিত।
২০১৩ সাল থেকে গুমবিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশ সফরের অনুমতি পেতে বেশ কয়েকবার অনুরোধ জানিয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ এপ্রিলে বাংলাদেশকে সফরের অনুরোধ জানিয়েও সাড়া পায়নি ওয়ার্কিং গ্রুপ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিগত এক দশকে দেশ এমন অবস্থার সাক্ষী যেখান থেকে গণতন্ত্র ক্রমেই সরে গেছে। এমন এক শাসনব্যবস্থার সাক্ষী হয়েছে, যা গণতন্ত্রের যেকোনো রূপ থেকেই অনেক দূরে। ক্ষমতাসীনরা বলপ্রয়োগের ওপরেই আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। দেশ শাসনে এখন বলপ্রয়োগের বাহিনীগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে। বিগত দুই নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির বিষয়টি অনেক দূরে চলে গেছে। যদিও এগুলোকে ‘নির্বাচন’ বলা যায় কি না, তাও একটি প্রশ্ন।
আরও বলেন, সুষ্ঠূ ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহির যে প্রক্রিয়া, তা যখন কার্যত অবসিত হয়েছে, তখন আরও বেশি দরকার হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জবাবদিহির চেষ্টা করা। কিন্তু, গুমের বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) কথা বলতে পারার ব্যর্থতার মাধ্যমেই জবাবদিহি না থাকায় তৈরি হওয়া সংকটের গভীরতা বোঝা যায়।
তারা বলেন, গুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার সময়ে এটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার যে, গুমের বিষয়টি শাসনব্যবস্থা ও জবাবদিহির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত; আর এটা খুব স্পষ্টভাবে বলা যে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ