পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বনাঞ্চল আমাজন। বনাঞ্চলটি এতো বড় যে, দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে পৃথিবীর নবম বৃহত্তম দেশ হতো আমাজন। যুক্তরাজ্য এবং আয়ারল্যান্ড অনায়াসে ১৭ বার রাখা যাবে এ বনাঞ্চলে। ৯টি দেশ মিলে বিস্তৃত এই বন। এটি একটি এমন ইকোসিস্টেম যা পুরো পৃথিবীর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। এত বড় বনাঞ্চল ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীর ফুসফুস হিসেবে পরিচিত ব্রাজিলের আমাজন বনে চলতি বছরের জানুয়ারিতে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক বেশি গাছ কাটা হয়েছে।
দেশটির সরকারি স্যাটেলাইটের তথ্যের বরাতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
এতে বলা হয়, যে পরিমাণ এলাকার গাছ কাটা হয়েছে তা ২০২১ সালের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি। ২০১৫ সালে এ বিষয়ে তথ্য সংরক্ষণ করার পর থেকে জানুয়ারিতে এটিই বন উজাড়ের সর্বোচ্চ ঘটনা।
জানুয়ারিতে আমাজনের ৪৩০ বর্গকিলোমিটার বন উজাড় করা হয়েছে। যা নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের চেয়ে আয়তনে সাতগুণ বড়।
পরিবেশবাদীরা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোকে বন উজাড় ত্বরান্বিত করার অনুমতি দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যদি আমরা জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে চাই তবে আমাজনকে রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। গাছগুলো কাটা হয় মূলত কাঠ ও ফসল চাষের জন্য; আর উৎপাদিত ফসল চলে যায় বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, ব্রাজিলের মহাকাশ সংস্থা ইনপের সর্বশেষ উপগ্রহের তথ্য আবারও বন রক্ষায় দেশটির সরকারের প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
গ্রিনপিস ব্রাজিলের কর্মকর্তা ক্রিস্টিয়ান মাজেট্টি বলেন, নতুন তথ্যে আবারও প্রকাশ পেল কীভাবে সরকারের পদক্ষেপগুলো তার সবুজায়ন নিয়ে প্রচারণার সম্পূর্ণ বিপরীত।
এদিকে ব্রাজিলের সরকার বলছে, গত বছরের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে সামগ্রিকভাবে কম বন উজাড় হয়েছে।
গত বছর গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ২৬ সম্মেলনে ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় বন্ধে একশ’র বেশি দেশের সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেখানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া বিশ্বেনেতাদের মধ্যে বলসোনারোও ছিলেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে পরিস্থিতি আগের মতোই রয়ে গেছে।
পরিবেশবাদি সংগঠনগুলো বলছে, বলসোনারোর আমলেই খনন কাজ আর কৃষি জমি তৈরির জন্য বননিধন বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এই প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে সন্দিহান তারা।
জানুয়ারিতে আমাজনের ৪৩০ বর্গকিলোমিটার বন উজাড় করা হয়েছে। যা নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের চেয়ে আয়তনে সাতগুণ বড়।
গ্রিনপিস আমাজন ক্যাম্পেইনের মুখপাত্র রোমুলো বাতিস্তা বলেন, বননিধন এবং আগুন লাগার ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং আদিবাসী ও স্থানীয়দের মধ্যে সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। এই প্রতিশ্রুতি আদৌ বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন করবে না।
২০১৯ সালে জাইর বলসোনারো ক্ষমতায় বসার পর আমাজনের ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার খোয়া গেছে এক বছরেই, যার আয়তন প্রায় লেবাননের সমান। গত দশকে এটা ছিল ৬ হাজার পাঁচশ বর্গকিলোমিটার।
ব্রাজিলের পরিবেশমন্ত্রী জোয়াকিম লেইটে বলছেন, বন উজাড়ের এই তথ্য আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে এবং এসব অপরাধ প্রতিরোধে আমাদেরকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
দক্ষিণ আমেরিকার ছোট–বড় নয়টি দেশকে ঘিরে রয়েছে আমাজন অরণ্যের বিস্তার। এই দেশগুলো হলো ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল, পেরু, বলিভিয়া, কলাম্বিয়া, ইকুয়েডর, গায়ানা, সুরিনাম আর ফ্রান্স (ফ্রান্স গায়ানা)।
বিশ্বের ১২টি রেইনফরেস্টের মধ্যে আমাজন বেসিনের রেইনফরেস্ট বৃহত্তম। প্রকৃতপক্ষে এর আয়তন ছিল ২ দশমিক ১২৪ মিলিয়ন বর্গমাইল। দক্ষিণ আমেরিকার আয়তন ৬ দশমিক ৮৯০ মিলিয়ন বর্গমাইল।
পাঁচ দশক ধরে মানুষ এই অরণ্যকে সংকুচিত করে চলেছে অপরিণামদর্শিতার সঙ্গে। ৫৫ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর আগেও আমাজন অরণ্যের অস্তিত্ব ছিল বলে ভূতত্ত্ববিদদের অভিমত। এর জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকান প্লেট (আটলান্টিক ওশানে মেজর টেকটোনিক প্লেট, যার মধ্যে পুরো দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ রয়েছে এবং এটি আফ্রিকান প্লেট পর্যন্ত বিস্তৃত) এবং নাজকা প্লেটের সংঘর্ষে যখন আন্দিজ পর্বতমালার সৃষ্টি হয়।
ব্রাজিল থেকে গায়ানা পর্যন্ত এক বিরাট অঞ্চল সেই সংঘর্ষেই জেগে ওঠে। মাঝখানে বয়ে যায় আমাজন নদীসহ অসংখ্য নদনদী। এখানে প্রথম প্রাণের লীলা চাঞ্চল্য জেগে ওঠে সবুজ ঘাসের আস্তরণে। তারপর বৃক্ষরাজি, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি আর মানুষের আশ্রয়দাতা হয়ে ওঠে আমাজন রেইনফরেস্ট।
জীবের জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন যতটা জরুরি, পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীর সব রেইনফরেস্ট। রেইনফরেস্ট পৃথিবীর ফুসফুস। এরা কেবল জল, বায়ু, খাদ্য আর ওষুধ উৎপাদনের উৎস নয়; হাজারো প্রাণিপ্রজাতির আশ্রয়দাতা। বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস শুষে নেওয়ার শক্তিশালী শোষক।
একুশ শতকের পরিবর্তিত জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব রুখে দিতে সে কারণেই কিংবদন্তি ভূমিকা রয়েছে রেইনফরেস্টগুলোর। এ জন্যই আমাজন অরণ্যের ধ্বংস নিয়ে সারা পৃথিবী উদ্বিগ্ন আজ।
বিশ শতক থেকে যেভাবে সারা বিশ্বে অরণ্যভূমি বিনষ্ট করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, অতীতে সেভাবে কোনো দিনও হয়নি। বরং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা বজায় রেখে হাজার হাজার বছর ধরে অরণ্যবাসী মানুষ ও বন্য প্রাণী বসবাস করে এসেছে অরণ্যের অভ্যন্তরে। এরপর জনসংখ্যা যত বেড়েছে, জড়বিজ্ঞানের প্রবল প্রতাপ যত বেশি আকাশচুম্বী হয়েছে, ততই অরণ্য সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।
১৯৭০ সালে আমাজনের বনভূমি প্রথম ধাপে উজাড় হওয়া শুরু হয় যখন ব্রাজিলের সামরিক সরকার খেয়াল করে এই বনের ভেতর লুকিয়ে আছে বিশাল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এ বন থেকে ব্রাজিলের তৎকালীন সরকার অর্থনৈতিক উন্নতির অপার সম্ভাবনা দেখছিল। কিন্তু দুর্গম বনভূমির জন্য এগুলো সংগ্রহ করা অসম্ভব ছিল। তাই ব্রাজিলের সরকার আমাজনের ভেতর দিয়ে ৩,২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ট্রান্স-আমাজনিয়ান হাইওয়ে নির্মাণ করা শুরু করে যা আমাজনের গহীন অরণ্যে মানুষের প্রতিনিয়ত চলাচলের সূচনা করে।
ওই সময়ে ব্রাজিলের বেশিরভাগ মানুষ দক্ষিণ-পূর্বে রিও-ডি-জেনিরো, সাও পাওলোর মত শহরে থাকতো। ব্রাজিলের সরকার জমি চাষাবাদ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে জনগণকে আমাজনে স্থানান্তর করতে চেয়েছিল। এই লক্ষ্যে ব্রাজিলের সরকার এই হাইওয়ের পাশে বিনামূল্যে জমির বিতরণ করা শুরু করেছিল, এরই সাথে সাথে জনগণকে প্রণোদনা দেওয়াও শুরু হয়েছিল এখানে বসতি স্থাপনের জন্য। হাইওয়ে নির্মাণের সাথে সাথে তার চারপাশের বন উজাড়ের হারও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এসকল বেশিরভাগ জমিই গরুর খামার করার জন্য চারণভূমিতে রুপান্তরিত করা হয়। লাভবান ব্যবসা হওয়ায় চারণভূমি বাড়ানোর জন্য আমাজনের আরো গহীনে বনভূমি উজাড় করা শুরু হয়।
জড়বিজ্ঞান সভ্যতায় বছরের পর বছর ধরে সীমাহীন নগরায়ণের কারণে, শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজে, আসবাবপত্র কিংবা জ্বালানির ব্যবহারে, কৃষিজমির অনুসন্ধানে এবং আরও হাজার রকমের নিষ্ঠুর অভিপ্রায় নিয়ে বিশাল বিস্তীর্ণ বনভূমিকে মানুষ নিঃশেষিত করেছে অপূরণীয় ক্ষতিতে।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এখন স্পষ্ট। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে নিয়মিত ভাবে দাবদাহ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। একইসঙ্গে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও।
এছাড়া বনের গাছ কেটে ফেললে সেটিও জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। কারণ গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং বিপুল পরিমাণে বন উজাড় হলে বায়ুতে ক্ষতিকর এই গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর তাই আমাজনে বন উজাড়ের এই ঘটনা পুরো বিশ্বের জন্যই চ্যালেঞ্জ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, যত বেশি বনাঞ্চল ধ্বংস হবে, তত বেশি মারণ ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ, বনভূমি হল মানুষ ও ভাইরাসের মাঝে ঢাল। এমনটা আগেই জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। বন্য প্রাণীর শরীরে থাকা অজানা ভাইরাস ছড়ানো রোধ করতে হলে বনাঞ্চল ধ্বংস আটকাতে হবে সবার আগে।
তারা বলছেন, করোনার পরবর্তী ভাইরাস ছড়াতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্য আমাজন থেকে। কারণ সেখানে নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। আর সেটা সব থেকে চিন্তার বিষয় এখন।
সারা বিশ্বের ২০ শতাংশ অক্সিজেনের জোগান দেয় আমাজন বনভূমি। তার থেকেও বড় কথা, এই বনভূমিতে বহু নাম না জানা প্রাণীও রয়েছে। তাদের শরীরে রয়েছে অজানা প্রাণঘাতী ভাইরাস। সেই ভাইরাস একবার মানুষের মধ্যে ছড়াতে শুরু করলে বিপদ।
ব্রাজিলের পরিবেশ বিজ্ঞানী ডেভিড লাপোলা জানিয়েছেন, বনাঞ্চলে নগরায়ন করলে বিভিন্ন প্রাণী থেকে ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়ানো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমাজনের গভীর অরণ্যে বহু চেনা-অচেনা ভাইরাস রয়েছে। মানুষ বনাঞ্চল ধ্বংস করে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলে সেই ভাইরাসে সংক্রমিত হবে। আর আমাজন যেভাবে ধংস করা হচ্ছে তাতে এর পর সেখান থেকেই নতুন কোনও ভাইরাস ছড়াতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ