মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ও বিভিন্ন সংগঠিত সশস্ত্র বেসামরিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেড়েই চলেছে। এক বছর আগে সামরিক জান্তা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অনেক তরুণ জীবনবাজি রেখে লড়াই করছে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। জান্তা-জনতা এখন মুখোমুখি। এক দেশে পরস্পর হয়ে গেছে পরস্পরের শত্রু।
এরমধ্যে বিক্ষুব্ধ সাগাইং অঞ্চলে জান্তাবিরোধী শক্তিকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে দুটি গ্রামের ৪০০টিরও বেশি বাড়িঘর জান্তা সেনারা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আনুমানিক দশ হাজার বেসামরিক লোককে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। তারা নিকটবর্তী গ্রামের মঠগুলো এবং বনে অস্থায়ী জঙ্গল শিবিরে আশ্রয় নেয়। খবর ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি ও ব্লুমবার্গ।
আরএফএ-র মিয়ানমার সার্ভিসকে সুত্রগুলো জানায়, সোমবার সন্ধ্যায় পার্শ্ববর্তী ম্যাগওয়ে অঞ্চলের মায়াং শহর থেকে প্রায় ১০০ সেনা সাগাইং-এর প্যালে শহরের মেওয়ে টোন এবং প্যান গ্রামে প্রবেশ করে সেখানে আগুন ধরাতে শুরু করে।
অত্যাচারের ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রামবাসী জানান, সেনারা মেওয়ে টোন গ্রামের ২৬৫টি বাড়ির মধ্যে ২২০টি এবং প্যান গ্রামের ৮০০ বাড়ির প্রায় এক-চতুর্থাংশ ধ্বংস করে ফেলেছে।
গ্রামবাসী জানায়, সেনারা গ্রামে প্রবেশ করার পর তারা পালাতে সক্ষম হলেও জিনিসপত্র সাথে নিতে পারেনি। আগুনে তাদের গবাদি পশু পুড়ে গেছে।
তিন কিলোমিটার দূরের প্যান গ্রাম আক্রমণের বিস্তারিত তখনো জানা যায়নি।
আরএফএ-কে গ্রামবাসীরা জানান যে, ইন মা তী গ্রামে সামরিক বাহিনীর হতাহতের প্রতিশোধস্বরূপ গ্রাম দুটি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।
মেওয়ে টোন ও প্যান গ্রামের বাসিন্দারা জানায়,হামলার সময় দুই গ্রাম ও তাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রায় দশ হাজার মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালায়।তারা নিকটবর্তী গ্রামে মঠগুলিতে এবং বনে অস্থায়ী জঙ্গল শিবিরে আশ্রয় নেয়।
অং সান সু চি’র নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশটিতে এমন রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
এরমধ্যে বিক্ষুব্ধ সাগাইং অঞ্চলে জান্তাবিরোধী শক্তিকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে দুটি গ্রামের ৪০০টিরও বেশি বাড়িঘর জান্তা সেনারা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আনুমানিক দশ হাজার বেসামরিক লোককে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। তারা নিকটবর্তী গ্রামের মঠগুলো এবং বনে অস্থায়ী জঙ্গল শিবিরে আশ্রয় নেয়।
দীর্ঘ কয়েক দশক সামরিক শাসনাধীনে থাকার পর ২০০৮ সালের সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী ২০১০ সাল থেকে জাতীয় নির্বাচন শুরু হয় মিয়ানমারে। সংশোধিত সংবিধানে দেশটির পার্লামেন্টের মোট আসনের ২৫ শতাংশ ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ ৩টি মন্ত্রণালয় সামরিক বাহনীর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়।
কিন্তু ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন দেশটির রাজনৈতিক দল এনএলডির বিপুল বিজয় সাংবিধানিক সেই হিসাব ওলট-পালট করে দেয়। বিশাল সেই জয়ে জাতীয় পার্লামেন্টের ৮৩ শতাংশ আসনে এনএলডি প্রার্থীরা বিজয়ী হন।
ফলে, নির্বাচনের পর বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগির প্রশ্নে অস্বস্তি শুরু হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে। এর প্রেক্ষিতেই নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে ভোটার তালিকা প্রকাশে নির্বাচন কমিশন বরাবর দাবি জানায় সেনাবাহিনী। তারপর গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী।
এদিকে মিয়ানমারে জরুরি অবস্থার মেয়াদ ৩১ জুলাই পর্যন্ত বাড়িয়েছে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক বাহিনী। ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন চ্যানেল এমআরটিভিতে দেওয়া এক ভাষণে জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লেইং এ সম্পর্কে বলেন, ‘সহিংসতা ও সংঘাত দূর না হলে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কায়াহ, শিন, সাগাইংসহ দেশের বিভিন্ন প্রদেশ ও অঞ্চলে এখনও সহিংসতা চলছে। আমরা সেইসব অঞ্চলের সংঘাত নিয়ন্ত্রণে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।’
ঠিক এক বছর আগে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। তারপর থেকেই সেনাঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে টানা বিক্ষোভ চলছে।
সহিংসতার তীব্রতা ও ব্যাপ্তি যেভাবে বাড়ছে এবং বিরোধীরা যেভাবে সমন্বিত হামলা করছে তাতে এই সংঘাত ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধে রূপ নিচ্ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
বিবিসি জানায়, সংঘাতের উপর নজরদারি এবং তথ্য সংগ্রহাক প্রতিষ্ঠান অ্যাকলেড (আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্ট) এর তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমার জুড়েই এখন সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় নানা মাধ্যম থেকে পাওয়া খবরও বলছে, লড়াই করা দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় বেড়েছে এবং তারা একজোট হয়ে লড়ছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সশস্ত্র লড়াই এখন শহর এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে, আগে এমনটা দেখা যেত না।
বছরের পর বছর ধরে সামরিক শাসনের অধীনে থাকার অভিজ্ঞতা মিয়ানমারবাসীর রয়েছে। তবে গত এক বছরের জান্তা শাসনে দেশটিতে রক্ত ঝরেছে প্রচুর। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তাবিরোধী তুমুল বিক্ষোভ, বিশেষত তরুণদের প্রতিবাদ, রক্তপাত মিয়ানমারকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অনেকে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন।
দেশটির একটি মানবাধিকার সংগঠনের বরাতে বার্তা সংস্থা এএফপি গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছে, মিয়ানমারে গত এক বছরের সংঘাতে ১ হাজার ৫০০ জনের বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই জান্তাবিরোধী। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি–হামলায় তারা প্রাণ হারান। এক বছরে দেশটিতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১১ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ। আর জান্তার হিসাবে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মিয়ানমারে ১৬৮ সেনা ও পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাশেলেট বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মিয়ানমারের এখনকার পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধে রূপ নিচ্ছে। সংঘাতকবলিত দেশটিতে শান্তি ফেরাতে ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে এবং কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, মিয়ানমারের সংঘাতময় পরিস্থিতি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৯
আপনার মতামত জানানঃ