যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ যখন র্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তখন বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমসহ সরকারি প্রতিক্রিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাব যে নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে এবং তা কতটা সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ফেলতে পারে, তা বিবেচনার মধ্যে ছিল না। র্যাবের পেছনে থাকা রাজনৈতিক শক্তির দায় কতটা, তাও ছিল না বিবেচনায়।
আইনবহির্ভূত কাজের যেকোনো দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা বাহিনীকে অবশ্যই নিতে হবে। কিন্তু এই ঘটনাগুলোর দায় কি শুধুই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা এর কিছু সদস্যের? র্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি নিজেরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এসব ঘটনা ঘটায় নাকি আইনশৃঙ্খলা দমনে তারা সরকারের নেওয়া নীতি বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন ঘটায়?
সরকারের ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ প্রবণতা
র্যাব নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বেশি কিছু অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সর্ব সাম্প্রতিক (গত শুক্রবার) বক্তব্যে কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গেল। ‘র্যাব তৈরি করেছে আমেরিকানরা আর ব্রিটিশরা।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘তাদের (র্যাব) প্রশিক্ষণ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা শিখিয়েছে কীভাবে মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে, হাউ টু ইন্টারোগেশন (কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে)। এখন যদি এসবে কোনো সমস্যা হয়ে থাকে কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, তাহলে আবার নতুন করে ট্রেনিং (প্রশিক্ষণ) হবে।’
এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, র্যাব সৃষ্টি কোন সময় হয়েছিল, এটা সবাই জানে। যারা র্যাব সৃষ্টি করেছে, তারাই র্যাবকে নিয়ে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে।
র্যাব বিএনপির আমলে তৈরি হয়েছে বা র্যাব গঠন করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন; মন্ত্রীদের তরফে এ ধরনের বক্তব্য আসলে বর্তমান পরিস্থিতির গভীরতার সঙ্গে ঠিক মেলে না। র্যাব কোন সরকারের আমলে তৈরি হয়েছে বা তাদের কারা প্রশিক্ষণ দিয়েছে; সামনের দিনগুলোর গতিপ্রকৃতি মোকাবিলায় তা খুব প্রাসঙ্গিক নয়।
র্যাবের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম চলে সরকারের অধীনে, সুতরাং এই প্রতিষ্ঠানকে সরকার কীভাবে ব্যবহার করছে, সেটাই হলো আসল কথা।
কতটা দায় আওয়ামী লীগের?
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির বিজ্ঞপ্তিতে বেসরকারি সংস্থার সূত্রে পাওয়া কিছু পরিসংখ্যান উল্লেখ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, র্যাবের বিরুদ্ধে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬০০টির বেশি গুম, ২০১৮ সাল থেকে ৬০০ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
এসব পরিসংখ্যানের বাইরে দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে র্যাবসহ বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে। আইনবহির্ভূত কাজের যেকোনো দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা বাহিনীকে অবশ্যই নিতে হবে।
কিন্তু এই ঘটনাগুলোর দায় কি শুধুই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা এর কিছু সদস্যের? র্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি নিজেরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এসব ঘটনা ঘটায় নাকি আইনশৃঙ্খলা দমনে তারা সরকারের নেওয়া নীতি বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন ঘটায়?
ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্ত অপরাধীদের হত্যার একটি নীতি যে সরকারের রয়েছে এবং তা যে চলে আসছে, সে ব্যাপারে আর যা-ই হোক জনমনে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারের এ ধরনের অবস্থান নিয়ে কোনো রাখঢাক আছে বলেও মনে হয় না।
সরকারি দলের নেতা, সাংসদ এমনকি মন্ত্রীদের মুখেও ‘ক্রসফায়ারের’ পক্ষে সাফাই শোনা যায়। গত নভেম্বরেই শিল্প প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদারের মুখে বিচারবহির্ভূত হত্যার পক্ষে বক্তব্য শোনা গেছে।
‘অনেক সময় বিরোধী নেতারা বলেন, আমরা ক্রসফায়ার দিয়ে মানুষ হত্যা করছি। আমি ক্রসফায়ারের পক্ষে। এই জন্য পক্ষে, একজন সন্ত্রাসীর কারণে লাখ লাখ মানুষের ঘুম যেখানে হারাম হয়ে যায়, সেই সন্ত্রাসীর সমাজে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নাই।’
একজন মন্ত্রীর মুখে এ ধরনের বক্তব্য দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে ক্ষুব্ধ করেছে, তারা বিবৃতি দিয়ে এর প্রতিবাদ করেছে। এরপরও মন্ত্রী কিন্তু তার অবস্থান থেকে সরে আসেননি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এ নিয়ে প্রশ্ন করলে কামাল মজুমদার তার আগের বক্তব্যে অটল ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি, যারা সমাজের লক্ষ লক্ষ মানুষকে জিম্মি করে রাখছে, যারা মদ-ইয়াবা নিয়ে ব্যবসা করে নতুন প্রজন্মকে ধ্বংস করছে, যারা চান্দাবাজি, টেন্ডারবাজি করছে, যারা মানুষকে ধ্বংস করছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা হরণ করছে, আমি তাদের ক্রসফায়ার দেওয়ার কথা বলছি।’
আমাদের মনে আছে সংসদে ধর্ষণকারীর ক্রসফায়ার চেয়েছেন জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ ও তরীকত ফেডারেশনের সাংসদেরা। সিলেট এমসি কলেজে ধর্ষণের ঘটনার পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ অভিযুক্তদের ক্রসফায়ারে দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘আমার যদি সুযোগ থাকত, আমি এটাই বলতাম, এদের বিচারের কাঠগড়ায় নয়, এদের সরাসরি ক্রসফায়ারে দিয়ে দিতে।’
মূলত আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও দুর্বৃত্তের দমনে ব্যর্থতা এবং অনেক ক্ষেত্রে বিচারহীনতার কারণে জনমনেও ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যার ব্যাপারে একধরনের সায় রয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি বাস্তব পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং সরকার সেই নীতি বাস্তবায়নে র্যাবের মতো প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগাচ্ছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনে প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাবের দায়ের চেয়েও সরকারের দায়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। নিষেধাজ্ঞা হয়তো র্যাবের বিরুদ্ধে এসেছে কিন্তু এটা কার্যত এসেছে সরকার যে নীতির ভিত্তিতে র্যাবকে পরিচালনা করছে বা ব্যবহার করছে তার বিরুদ্ধে। সরকার যদি বিচারবহির্ভূত হত্যার নীতি থেকে সরে আসে, তবে কি র্যাবের পক্ষে সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করা সম্ভব?
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ