অতিমারির ফলে প্রায় প্রতিটি দেশে লকডাউন হয়েছে। অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েছে। প্রচুর মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। বহু মানুষ গরিব হয়েছেন। গরিব আরও গরিব হয়েছে।
দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, করোনা মহামারির কারণে দেশে দেশে লকডাউন দেওয়া হয়। শুরু হয় চাকরির খরা, মানুষের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় কষ্ট। এই ভাইরাসকে দূরে রাখতে শুরু হয় তীব্র লড়াই। লাখ লাখ মানুষ আবার দারিদ্র্যের কাতারে নেমে যায়।
করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে নেওয়া হয়। নতুন উদ্যমে শুরু হয় অর্থনৈতিক কার্যক্রম। অনেকে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ওয়ার্ল্ড ডেটা ল্যাবের ওয়ার্ল্ড পোভার্টি ক্লকের হিসাবে, ২০২০ সালের শেষ নাগাদ দৈনিক ২ ডলারের কম আয় করেন, এমন মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৭৫ কোটি। কিন্তু এই বছরের শেষ নাগাদ এই সংখ্যা কমে ৬৮ কোটি ৫০ লাখে নেমে আসতে পারে, অর্থাৎ মহামারির আগের পর্যায়ে ফিরে যাবে। তবে এই দারিদ্র্য হ্রাসে সময় লাগবে। সূত্র: প্রথম আলো
আইএমএফ বলেছে, ২০২২ সালে কিছু ধনী দেশের প্রবৃদ্ধির হার গরিব দেশগুলোর তুলনায় বেশি হবে। কিন্তু গত দুই বছরে এমন কিছু ক্ষতি হয়েছে, যা কোনো দিন পূরণ করা সম্ভব হবে না। শিশুদের মধ্যে খাবার না খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করানোর কারণে দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা তৈরি হতে পারে। যারা ভয়ে সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছেন, সেই সম্পদ আবারও কিনতে হলে তাদের কয়েক বছর সঞ্চয় করতে হবে।
মধ্য আয়ের দেশগুলোতে যারা দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে বসবাস করত, তারা আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে এশিয়ায় আবারও দারিদ্র্য বেড়েছে। বিশেষ করে ভারতে লাখ লাখ মানুষকে নতুন করে লড়াই করতে হচ্ছে। কিন্তু এই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা থমকে গেলে দারিদ্র্য আবারও বেড়ে যাবে, বিশেষ করে আফ্রিকার সাবসাহারা অঞ্চল ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোতে। ওয়ার্ল্ড ডেটা ল্যাবের তথ্যমতে, ২০৩০ সাল নাগাদ ২ ডলারের নিচে যাঁদের আয়, তাদের ৬০ শতাংশের বসবাস হবে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোতে। আর স্থিতিশীল দেশগুলো চরম দারিদ্র্যসীমার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন শহরে দারিদ্র্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ২০২২ সালে দরিদ্র ব্যক্তিদের প্রতি ১০ জনের ১ জন হবেন শহরাঞ্চলের বাসিন্দা। অনেকেই বাড়ির পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা রাস্তায় খাবার ফেরি করার মতো কাজ খুঁজবেন। যতক্ষণ না ভোক্তাদের আস্থা ফিরছে এবং করোনা মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে, ততক্ষণ কাজ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
গত অক্টোবর মাসে স্পেন, সিঙ্গাপুরের মতো কিছু দেশ জনসংখ্যার তিন–চতুর্থাংশকে টিকা দিতে পেরেছে। কিন্তু ইথিওপিয়া ও উগান্ডার মতো দেশগুলো মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের কম মানুষকে পূর্ণ ডোজ দিতে পেরেছে। চলতি বছর তো বটেই, এরপরও এই বৈপরীত্য বজায় থাকবে।
চরম দারিদ্র্য দূর করা অসম্ভব নয়, বলা হচ্ছে, বিশ্বের সব মানুষের প্রতিদিনের আয় ১ দশমিক ৯ ডলারের ওপরে নিতে দরকার ১০ হাজার কোটি ডলার। সহায়তা ও ব্যক্তিগত বদান্যতার মধ্য দিয়ে এই অর্থ জোগাড় করা সম্ভব।
অন্যদিকে নারী-পুরুষের ব্যবধান আরও বাড়বে। দাতব্য সংস্থা অক্সফামের হিসাবে, ২০২০ সালে বিশ্বে নারীদের আয় অন্তত ৮০ হাজার কোটি ডলার কমেছে। অনেক নারী চাকরি হারিয়েছেন বা মেয়েরা স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে, যারা আর বিদ্যালয়ে ফিরতে পারছে না। সঠিক সময় বা পরিকল্পনার আগে অনেক নারীর বিয়ে হয়ে গেছে বা এমনকি তাঁরা মা-ও হয়েছেন। জাতিসংঘের নারীবিষয়ক সংস্থার হিসাব অনুসারে, ২০৩০ সাল নাগাদ ১০০ জন পুরুষের বিপরীতে ১২১ জন নারী দরিদ্র হবেন। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১১৮।
তবে এত আশঙ্কার মধ্যে কিছুর আশার কথাও আছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত দরিদ্রদের নগদ অর্থ প্রদানসহ ৩ হাজার ৩০০-এর বেশি সামাজিক সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। ধনী দেশগুলো সরকারি ঋণ পরিশোধ স্থগিত করেছে। চরম দারিদ্র্য দূর করা অসম্ভব নয়, বলা হচ্ছে, বিশ্বের সব মানুষের প্রতিদিনের আয় ১ দশমিক ৯ ডলারের ওপরে নিতে দরকার ১০ হাজার কোটি ডলার। সহায়তা ও ব্যক্তিগত বদান্যতার মধ্য দিয়ে এই অর্থ জোগাড় করা সম্ভব।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, করোনা প্রতিরোধে বিধিনিষেধ চলাকালে বিশ্ব অর্থনীতিতে অতিধনীদের সম্পদ ফুলে–ফেঁপে উঠেছে, বিশেষ করে যারা অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে জড়িত। বৈশ্বিক পুনরুদ্ধারের গতি জোরদার হওয়ার সুবাদে আর্থিক বাজারগুলোয় চাঙাভাব দেখা দেওয়ার কারণে অন্যদের সম্পদ বেড়েছে।
মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার মধ্যে খাদ্য প্রথম। সেই খাদ্যের জোগানের একমাত্র মাধ্যম কৃষি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা অধ্যুষিত বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ এখনো খাদ্যের অভাবে ধুঁকে মরছে। করোনা মহামারি যেন জ্বলে আসা আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। এতে নতুন দরিদ্র হয়েছে আরও অনেকে। তবে একদিকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ও খাদ্য সংকট বাড়লেও অন্যদিকে বিশ্বে বাড়ছে অতিধনীদের সংখ্যা। অল্প কিছু অতিধনী সাহায্য করলে বিশ্বের চলমান খাদ্যসংকট মেটানো সম্ভব বলে দাবি করেছেন জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) পরিচালক ডেভিড বিসলি।
সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) পরিচালক ডেভিড বিসলি বলেছেন, এসব ধনকুবের যদি তাদের সম্পদের সামান্য অংশ দান করেন, তাহলে বিশ্বের বহু মানুষের মুখে দুমুঠো খাবার জুটবে। চাইলে অতিধনীদের কোনো একজনের একবারের দানেই বিশ্বজুড়ে অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা এসব মানুষ প্রাণে বাঁচবে।
ডেভিড বিসলি বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ চরম খাদ্যসংকটে ভুগছে। তাদের সাহায্যে ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন। আমরা যদি সাহায্য নিয়ে তাদের কাছে পৌঁছাতে না পারি, তাহলে যেকোনো সময় তারা মারা যেতে পারে।’ তাদের সাহায্যে এখনই ধনকুবেরদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
করোনাকালে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই চলছে অর্থনৈতিক সংকট৷ স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে খাদ্যনিরাপত্তাও পড়েছে সংকটে৷ বাড়ছে ক্ষুধার্তের সংখ্যা৷
২০২০ সালে প্রতি দশজনে একজন মানুষ অন্তত পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য পায়নি৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং সাব সাহারান আফ্রিকার যেসব অঞ্চলে পানির সংকট রয়েছে, কিংবা যেসব জায়গায় আঞ্চলিক সংঘাত চলছে, সেসব জায়গার মানুষ খাদ্যসংকটে বেশি ভুগেছে৷
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে একাধিক দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। গত কয়েক দশকে পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চাষযোগ্য জমি সংরক্ষণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, কৃত্রিম বনায়ন, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো, বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলো বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ব্যস্ত হয়ে আছে বিশ্বের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৬
আপনার মতামত জানানঃ