বিশ্বে করোনার আগমনের পর থেকে যে কোনো কারণেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া কঠিনতর হয়ে উঠেছে। অভিবাসনপ্রার্থী মানুষের জন্য প্রায় আরও অসম্ভব হয়ে উঠেছে অনুমোদন পাওয়া। এজন্য অনেকেই ঝুঁকছে অনৈতিক প্রক্রিয়ায় অভিবাসনের প্রতি। আর এভাবে দেশান্তরি হতে গিয়ে অনেকেই মৃত্যুর মুখে পড়ছে, কেউবা হচ্ছেন নিখোঁজ।
গত বছর স্পেনে পৌঁছানোর চেষ্টা করা অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে ৪ হাজার ৪০০ জনের বেশি সমুদ্রে হারিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছে ওয়াকিং বর্ডার নামের একটি পর্যবেক্ষণকারী গোষ্ঠী। নিখোঁজ এ অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে অন্তত ২০৫টি শিশুও আছে বলে সোমবার জানিয়েছে তারা। খবর রয়টার্স
গোষ্ঠীটি বলছে, ২০২১ সালে সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া এই হতভাগ্যদের সংখ্যা আগের বছরের দ্বিগুণেরও বেশি। ২০১৮ সাল থেকে ওয়াকিং বর্ডার এই সংখ্যা টুকছে, তখন থেকে আর কোনো বছরই এত অভিবাসন প্রত্যাশী নিখোঁজ হয়নি।
ওয়াকিং বর্ডার বা কামিনান্দো ফ্রন্তেরাস নামে পরিচিত এই গোষ্ঠীটি সমুদ্রে বিপুল সংখ্যক অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যুর জন্য ক্রমশ বিপজ্জনক রুট বেছে নেওয়া, নিম্নমানের নৌকা ব্যবহার এবং বিপদে পড়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের সহায়তার ক্ষেত্রে কিছু কিছু নৌযানের ভয়কে দায়ী করেছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
স্পেনের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৩৯ হাজার শরণার্থী গত বছর সড়ক বা সমুদ্র পথে পৌঁছেছেন দেশটিতে। এর আগের বছরও একই সংখ্যক শরণার্থী পৌছান সেখানে।
ওয়াকিং বর্ডারস বলছে, গত বছর ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার পথে ১২৪টি জাহাজডুবির দুর্ঘটনায় ৯০ শতাংশই নিখোঁজ। আফ্রিকার উত্তর-পূর্ব উপকূল থেকে কিছু দূরে আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত কতগুলো দ্বীপের সমষ্টি হচ্ছে ক্যানারি দ্বীপুঞ্জ। এগুলো স্পেনের অধীনস্থ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল।
২০২০ সাল থেকে আফ্রিকা উপকূলে থাকা এই দ্বীপপুঞ্জটি স্পেন পৌঁছাতে চাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের প্রধান গন্তব্যস্থলে পরিণত হয়েছে।
সেই তুলনায় অনেক কম লোকই এখন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে স্পেনের মূল ভূখণ্ডে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।
কামিনান্দো ফ্রন্তেরাসের প্রতিষ্ঠাতা হেলেনা মালেনো রয়টার্সকে বলেন, তারা মূলত নৌযানে সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে বিপদে পড়ার পর সাহায্য চাওয়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য রাখা হটলাইন এবং নিখোঁজদের সন্ধান চাওয়া পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য যোগাড় করে থাকেন।
গোষ্ঠীটি প্রতিটি নৌযানের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছে, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করে। একমাস বা তার বেশি সময় ধরে নিখোঁজ অভিবাসন প্রত্যাশীদের তারা মৃত ধরে নেয়। পরিসংখ্যানের তালিকায় উঠে আসা তথ্য প্রায় ৯৫ শতাংশই নিখোঁজ ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব করে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা অর্গানাইজেনশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৫৫ জন মানুষ ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছানোর চেষ্টা চালানোর সময় মারা যান বা নিখোঁজ হন। ২০১৪ সালের পর এটি সর্বোচ্চ।
আইওএম-এর অফিসিয়াল রেকর্ড, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং ওয়াকিং বর্ডারস যে তথ্য দিচ্ছে তার চেয়ে সেই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
সমুদ্র পথে যাওয়ার সময় কতজন মানুষ মারা যান বা নিখোঁজ হন সেই তথ্য সংরক্ষণ করে না স্পেন এবং দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সর্বশেষ পরিসংখ্যান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন।
গত বছর ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার পথে ১২৪টি জাহাজডুবির দুর্ঘটনায় ৯০ শতাংশই নিখোঁজ।
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, এ বছর(২০২১) প্রায় সাড়ে চার হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছে। যা গত বছরের পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যে মানুষের চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এত মানুষের প্রাণহানি ঘটলো।
আইওএম-এর গ্লোবাল মাইগ্রেশন ডেটা অ্যানালাইসিস সেন্টারের পরিচালক ফ্রাঙ্ক ল্যাকজকো এক বিবৃতিতে বলেছেন, নিখোঁজ অভিবাসী প্রকল্প এখনও প্রতিদিনই মৃত্যু সংখ্যা লিপিবদ্ধ করছে।
বিশ্ব শরণার্থী সংস্থা বলেছে, গত বছরের(২০২০) চেয়ে এ বছরে(২০২১) মৃত্যুর হার বেড়েছে। ২০২০ সালেই ৪ হাজার ২৩৬ জন মারা গেছেন। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত মৃত্যু ছাড়িয়েছে ৪৫ হাজার।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, চলতি বছর উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাজুড়ে এক হাজার ১২১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা গত বছর থেকে বেশি। এ বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে এক হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গ্রিস-তুরস্কের সীমান্তে এ পর্যন্ত ৪১ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সীমান্তে অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশী মারা গেছেন। বছর শেষ হওয়ার আগে এ পরিসংখ্যান আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হয় দালালের হাত ধরে ইতালি ও স্পেন প্রবেশের চেষ্টায় ভূমধ্যসাগরে ডুবে শত শত অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু। খবর আসে, আমেরিকায় যাওয়ার পথে বনে-জঙ্গলে দালালের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। ইউরোপে ঢোকার আশায় বলকানের বরফঢাকা জঙ্গলে হাজারো মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে অপেক্ষায় থাকার সংবাদও আসে। এ বছর ভূমধ্যসাগরে চার হাজারেরও বেশি অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। জুলাই মাসে প্রায় ৬০ বাংলাদেশির মৃত্যু হয় নৌকা ডুবে। অনেকেই মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তনই মূলত এই অভিবাসন প্রত্যাশার কারণ।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের সমুদ্রপথে বৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই। দেশের আইন অনুযায়ী তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়া তাদের আর কোনো বহির্গমন পথ নেই। প্রতারকচক্র সবকিছু জেনেও সাধারণ মানুষকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে সমুদ্রপথে পাঠানোর নামে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে।
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে যাত্রা করে স্বপ্নের দেশে নোঙ্গর করে না অনেক সমুদ্রযান। দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেক মানুষের জীবন হয় বিপন্ন। টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে মাঝপথেই প্রতারকরা পালিয়ে গেছে, এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে।
অনেক ক্ষেত্রে আটকে রেখে পরিবারের সদস্যদের কাছে দাবি করা হয় মুক্তিপণ। মেটাতে না পারলে চলে অমানুষিক অত্যাচার। অনেককে বিক্রি করে দেয়া হয় দাসশ্রমিক হিসেবে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের তালিকায় শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। ২১ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্রপাড়ি দিয়েছে বিভিন্ন দেশের ৪১ হাজার ৭৭৭ জন। তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার আছে বাংলাদেশি। গত ১০ জুনও ১৬৪ বাংলাদেশিকে তিউনিসিয়া উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়।
এর আগে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় ১৮ মে ৩৬ জন, ২৭ ও ২৮ মে ২৪৩ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। এ বছর এভাবে মোট তিন হাজার ৩৩২ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার বা আটক করা হয়।
ইউএনএইচসিআর-এর তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত নানা দেশের ২২ লাখ ২৪ হাজার ২৪৫ জন মানুষ সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে আসে। একই সময়ে এ পথে আসতে গিয়ে মারা গেছে ২১ হাজার ৭০৭ জন।
বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের সিলেটসহ কিছু জেলার মানুষের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা আছে। সেটি হলো— আপনি যদি কোনোভাবে ইউরোপে যেতে পারেন, তাহলেই জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের জন্য রওয়ানা হন, তাদের অধিকাংশের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে এবং তাদের একটি বিপুল অংশ লিবিয়া থেকে নৌপথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের চেষ্টা করেন
তারা বলেন, প্রতিবছর ইউরোপে যেসব বাংলাদেশি প্রবেশ করেন, তাদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ইউরোপে প্রবেশের জন্য প্রচুর টাকাপয়সা খরচ করতে হয় এবং পরিবার সেই টাকার যোগান দেয়। এ থেকে সহজেই ধারণা করা যায়, এই অনুপ্রবেশকারীদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। তারা এই বিষয়টিকে দেখছে একপ্রকার বিনিয়োগ হিসেবে। আগে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবার জমি বা বাড়ি নির্মাণের জন্য অর্থলগ্নি করতো, এখন তারা নতুন খাত হিসেবে ইউরোপ প্রবেশকে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা যদিও বরাবরই বলে আসছেন, দারিদ্র্যের কারণে এই প্রবণতা বাড়ছে এবং দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়লে এটি কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক তৎপরতা ও উন্নয়ন যেমন বাড়ছে, সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতিবছর ইউরোপে অবৈধ অনুপ্রবেশের হারও।
আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের সমন্বয় প্রয়োজন। পাশাপাশি, দালালদের ও ভুয়া রিক্রুটিং এজেন্সির সদস্যদের গ্রেপ্তার ও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পরস্পরকে দোষারোপ না করে ইউরোপ এবং বাংলাদেশ উভয়কেই এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৪
আপনার মতামত জানানঃ