শরিয়ার আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে এমন বার্তা দিয়ে এবার নতুন নির্দেশনা দিল তালিবান। জামা-কাপড়ের দোকানে থাকা ম্যানিকুইন বা মডেল পুতুলকে ‘মূর্তি’ অ্যাখ্যা দিয়ে এসবের মাথা কাটার নির্দেশ দিয়েছে। সম্প্রতি তালিবান কর্মকর্তারা আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশের দোকানিদের এই নির্দেশ দেয়।
আফগানিস্তানে দ্বিতীয় মেয়াদে তালিবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে একের পর এক কঠোর ইসলামী আইনকানুন জারি করছে তালিবান সরকার। সেই প্রেক্ষিতে এবার চলতি সপ্তাহে পাপ ও পূণ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ম্যানিকুইনের শিরশ্ছেদের আইন পাস হয়।
কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক পর্যায়ে দোকান থেকে সব ম্যানিকুইন সরানোর নির্দেশ দেয়। কিন্তু এমন অবস্থায় দোকানিদের ব্যবসায় ক্ষতি হবে-এ অভিযোগের মুখে ম্যানিকুইনের মাথা কাটার সিদ্ধান্ত দেন মন্ত্রণালয়ের প্রধান শেখ-আজিজ-উ-রহমান।
তালিবানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পুতুলের ব্যবহার হচ্ছে শরিয়ার আইনের লঙ্ঘন। আফগানিস্তানের পুণ্যের প্রচার ও পাপ প্রতিরোধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে নির্দেশ দিয়েছে হেরাতের সকল দোকান থেকে সব পুতুল সরিয়ে নিতে। কিন্তু ব্যবসায় ইতোমধ্যে খারাপ সময় যাচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ জানায়। এতে তালিবান নির্দেশনা দেয়, পুতুলগুলোর শিরশ্ছেদ করতে।
এ ব্যাপারে হেরাতের নীতিনৈতিকতা ও পাপ প্রতিরোধ বিষয়ক বিভাগের প্রধান আজিজ রহমান জানান,পবিত্রগ্রন্থে এগুলোকে (ম্যানিকুইন) মূর্তি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ইসলামের এসবের স্থান নেই। এগুলোকে আগে পূজা করা হতো। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন এগুলোর সাহায্যে তারা কাপড় প্রদর্শন করেন। আমরা তাদের এগুলোর (ম্যানিকুইন) মাথা অপসারণের নির্দেশ দিয়েছি।
এই নির্দেশ না মানলে ব্যবসায়ীদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলেও নীতিনৈতিকতা ও পাপ প্রতিরোধ বিষয়ক বিভাগ সতর্ক করেছে।
কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক পর্যায়ে দোকান থেকে সব ম্যানিকুইন সরানোর নির্দেশ দেয়। কিন্তু এমন অবস্থায় দোকানিদের ব্যবসায় ক্ষতি হবে-এ অভিযোগের মুখে ম্যানিকুইনের মাথা কাটার সিদ্ধান্ত দেন মন্ত্রণালয়ের প্রধান শেখ-আজিজ-উ-রহমান।
তবে বিক্রেতা ও শপিংমলের মালিকরা এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন।
এ ব্যাপারে আজিজ আহমেদ হায়দার নামে এক কাপড় বিক্রেতা জানান, আমরা কাপড় প্রদর্শনের জন্য ম্যানিকুইন ব্যবহার করি।
বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতেও কাপড় প্রদর্শনের জন্য ম্যানিকুইন ব্যবহার করা হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ম্যানিকুইনের শুধু মাথা কেটে ফেলায়ও তাদের আর্থিক ক্ষতি হবে। আফগানিস্তানের প্রায় ধ্বসে পড়া অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে এমন পদক্ষেপ নেওয়া অনুচিত।
ইতালীয় গণমাধ্যম রিপাবলিকা’কে আবদুল ওয়াদুদ ফাইজ জাদা নামক জনৈক ব্যক্তি বলেন, ‘ম্যানিকুইনের মাথা ঢেকে দিলেই হতো, বাদ দেওয়ার দরকার ছিল না। প্রতিটি ম্যানিকুইনের দাম ৬ থেকে ৮ হাজার টাকার মতো। এগুলোর শিরশ্ছেদ করলে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হবে’।
মোহাম্মদ ইউসুফ নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘তালিবানরা কিছুই বদলায়নি, আবারও আমাদের উপর কঠোর বিধিনিষেধের খড়্গ নেমে আসবে। তারা এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি, কিন্তু যখন পাবে তখন তারা আরও কঠোর অনুশাসন জারি করবে’।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সাথে সাথে দ্রুত দেশের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে তালিবান। গত আগস্টে ক্ষমতা দখলের পর থেকে ধীরে ধীরে দেশের জনসাধারণের স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে তারা। যদিও তালিবানরা একে ‘সংস্কারসাধন’ বলে দাবি করেছে।
শুধু তাই নয়, ‘নিরাপত্তা’র দোহাই দিয়ে চার দেয়ালের ভেতর বন্দী করে রাখা হয়েছে দেশের নারীদের। বহু অঞ্চলে মেয়েদের স্কুল-কলেজ ও কর্মস্থলে যাওয়াও নিষিদ্ধ করেছে তারা।
সাম্প্রতিক সময়ে পুরুষ অভিভাবক ছাড়া নারীদের দূরে কোথাও ভ্রমণের উপরেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তারা। এছাড়া গাড়ির ভেতরে থাকলেও মুখ ঢেকে রাখার নিয়ম জারি করা হয়েছে।
দেশের ভেতরে যানবাহনে গান বাজানো এবং ‘বিষাক্ত’ দ্রব্য নিষিদ্ধ করেছে তালেবান।
১৫ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা দখলের পর তালিবান আগের কঠোর মনোভাব থেকে সরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু নারীদের স্কুলে ফেরা এবং কর্মক্ষেত্রে ফেরার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাসহ নারীদের প্রতি তালিবানের বিরূপ মনোভাব অব্যাহত রয়েছে।
এর আগে ১৯৯৬-২০০১ সালে তালিবান সরকারের অধীনে নারীদের অধিকার সম্পূর্ণ হরণ করা হয়। কেনো মেয়ে স্কুলে যেতে পারতো না, বাইরে কাজ করতে পারতো না। সবাইকে বোরকা ও হিজাব পরিধান করতে হতো এবং বের হতে হলে পরিবারের একজন পুরুষ সদস্যকে বাধ্যতামূলত সঙ্গে রাখা লাগতো। এছাড়া তাদের জোর করে বাল্যবিবাহ দিতো তালিবান শাসকগোষ্ঠী।
তবে এবার ক্ষমতায় এসে তালিবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ইসলামি আইনের অধীনে তারা এবার নারীদের অধিকার নিশ্চিত করবে। যদিও সেটিতে এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না আফগান নারীরা।
এর মাঝেই গত মাসেই তালিবান নির্দেশ দিয়েছে, নারীরা যেন আপাতত ঘরে থাকে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নারীদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়, তা অনেক তালিবান সদস্য এখনো জানে না। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরই নারীরা বাইরে কাজের সুযোগ পাবে। তবে এটাকে তালিবানের এক প্রকার কৌশল বলে মনে করছেন অনেকেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তালিবানের আফগান দখলের পর থেকেই দেশটিতে নারীদের অবস্থান নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। অত্যাচার নিপীড়নের পাশাপাশি বাড়ি থেকে কম বয়সী নারীদের জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া এমনকি মৃতদের ধর্ষণের অভিযোগও উঠেছে তালিবানের বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রা থমকে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। কর্মজীবী নারীদের উপর নেমে আসছে নিয়মের খড়গ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৫
আপনার মতামত জানানঃ