উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলে এক শিশু ও দুই নারীসহ মোট ২৭ জনের মরদেহ ভেসে এসেছে। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে অভিবাসীদের বহনকারী নৌযান ডুবির ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রুটের এই ঘটনাকে সবশেষ ট্যাজেডি বলছে রেড ক্রিসেন্ট।
আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা সংস্থা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির লিবিয়া শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, শনিবার সন্ধ্যার দিকে লিবিয়ার উপকূলীয় শহর খোমসের সৈকতের দুটি পৃথক স্থানে লাশগুলো পড়ে ছিল। রাজধানী ত্রিপোলি থেকে খোমসের দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার (৫৫ মাইল)।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, দেশটির রাজধানী ত্রিপোলি থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরের উপকূলীয় শহর খোমসের দুটি পৃথক স্থান থেকে শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) রাতে একটি শিশু ও দুই নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বাকিদের খোঁজে সন্ধান চালাচ্ছে উদ্ধারকারী দল।
নিরাপত্তা কর্মকর্তার বরাতে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, অনেকের দেহে পচন ধরায় ধারণা করা হচ্ছে কয়েকদিন আগে নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটেছে। লিবিয়ার স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, উপকূলে সারিবদ্ধভাবে একাধিক মৃতদেহ ঢেকে রাখা হয়েছে। এদের কারও পরিচয় পাওয়া যায়নি।
ব্রিটিশ মিডিয়া বিবিসি নিউজ বলছে, ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ লিবিয়ার অপর তীরেই ইউরোপ। মানব পাচারকারীদের মাধ্যমে ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর এই বিপজ্জনক পথ দিয়ে ইউরোপে পাড়ি দিচ্ছেন অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। প্রতিকূল এই যাত্রাপথে দুর্ঘটনাও খুবই সাধারণ ব্যপার। জাতিসংঘের অভিবাসন কর্তৃপক্ষের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১ সালে সমুদ্রপথে নৌযান ডুবিতে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১৫শ অভিবাসন প্রত্যাশীর।
বিশ্লেষকদের মতে, সমুদ্রের বৈরী আবহাওয়ার পাশাপাশি ত্রুটিযুক্ত নৌযান ও অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের কারণেও ঘটে দুর্ঘটনা।
উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে লিবিয়ার উপকূলে নৌযান ডুবে ১৬০ জন অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছিল। তার রেশ কাটতে না কাটতেই শনিবার খোমস শহরের উপকূলে মরদেহগুলো ভেসে এলো। সামনের দু-একদিনে আরও লাশ আসতে পারে বলে মনে করছেন দেশটির নিরাপত্তা কর্মকর্তারা।
অনেকের দেহে পচন ধরায় ধারণা করা হচ্ছে কয়েকদিন আগে নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটেছে।
এক দশকের বেশি সময় ধরে সংঘাত ও অনাচারে জর্জরিত লিবিয়া। আফ্রিকান ও এশিয়ান অভিবাসীদের কাছে ইউরোপে পৌঁছানোর জন্য মূল প্রস্থান ‘পয়েন্ট’ হয়ে উঠেছে দেশটি।
বিশ্বে করোনার আগমনের পর থেকে যে কোনো কারণেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া কঠিনতর হয়ে উঠেছে। অভিবাসনপ্রার্থী মানুষের জন্য প্রায় আরও অসম্ভব হয়ে উঠেছে অনুমোদন পাওয়া। এজন্য অনেকেই ঝুঁকছে অনৈতিক প্রক্রিয়ায় অভিবাসনের প্রতি। আর এভাবে দেশান্তরি হতে গিয়ে অনেকেই মৃত্যুর মুখে পড়ছে। চলতি বছর বিশ্বজুড়ে রেকর্ডসংখ্যক অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে।
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, এ বছর প্রায় সাড়ে চার হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছে। যা গত বছরের পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যে মানুষের চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এত মানুষের প্রাণহানি ঘটলো।
আইওএম-এর গ্লোবাল মাইগ্রেশন ডেটা অ্যানালাইসিস সেন্টারের পরিচালক ফ্রাঙ্ক ল্যাকজকো এক বিবৃতিতে বলেছেন, নিখোঁজ অভিবাসী প্রকল্প এখনও প্রতিদিনই মৃত্যু সংখ্যা লিপিবদ্ধ করছে।
বিশ্ব শরণার্থী সংস্থা বলেছে, গত বছরের চেয়ে এ বছরে মৃত্যুর হার বেড়েছে। ২০২০ সালেই ৪ হাজার ২৩৬ জন মারা গেছেন। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত মৃত্যু ছাড়িয়েছে ৪৫ হাজার।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, চলতি বছর উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাজুড়ে এক হাজার ১২১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা গত বছর থেকে বেশি। এ বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে এক হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গ্রিস-তুরস্কের সীমান্তে এ পর্যন্ত ৪১ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সীমান্তে অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশী মারা গেছেন। বছর শেষ হওয়ার আগে এ পরিসংখ্যান আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হয় দালালের হাত ধরে ইতালি ও স্পেন প্রবেশের চেষ্টায় ভূমধ্যসাগরে ডুবে শত শত অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু। খবর আসে, আমেরিকায় যাওয়ার পথে বনে-জঙ্গলে দালালের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। ইউরোপে ঢোকার আশায় বলকানের বরফঢাকা জঙ্গলে হাজারো মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে অপেক্ষায় থাকার সংবাদও আসে। এ বছর ভূমধ্যসাগরে চার হাজারেরও বেশি অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। জুলাই মাসে প্রায় ৬০ বাংলাদেশির মৃত্যু হয় নৌকা ডুবে। অনেকেই মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তনই মূলত এই অভিবাসন প্রত্যাশার কারণ।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের সমুদ্রপথে বৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই। দেশের আইন অনুযায়ী তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়া তাদের আর কোনো বহির্গমন পথ নেই। প্রতারকচক্র সবকিছু জেনেও সাধারণ মানুষকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে সমুদ্রপথে পাঠানোর নামে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে।
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে যাত্রা করে স্বপ্নের দেশে নোঙ্গর করে না অনেক সমুদ্রযান। দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেক মানুষের জীবন হয় বিপন্ন। টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে মাঝপথেই প্রতারকরা পালিয়ে গেছে, এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে।
অনেক ক্ষেত্রে আটকে রেখে পরিবারের সদস্যদের কাছে দাবি করা হয় মুক্তিপণ। মেটাতে না পারলে চলে অমানুষিক অত্যাচার। অনেককে বিক্রি করে দেয়া হয় দাসশ্রমিক হিসেবে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের তালিকায় শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। ২১ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্রপাড়ি দিয়েছে বিভিন্ন দেশের ৪১ হাজার ৭৭৭ জন। তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার আছে বাংলাদেশি। গত ১০ জুনও ১৬৪ বাংলাদেশিকে তিউনিসিয়া উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের সিলেটসহ কিছু জেলার মানুষের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা আছে। সেটি হলো— আপনি যদি কোনোভাবে ইউরোপে যেতে পারেন, তাহলেই জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের জন্য রওয়ানা হন, তাদের অধিকাংশের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে এবং তাদের একটি বিপুল অংশ লিবিয়া থেকে নৌপথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের চেষ্টা করেন
তারা বলেন, প্রতিবছর ইউরোপে যেসব বাংলাদেশি প্রবেশ করেন, তাদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ইউরোপে প্রবেশের জন্য প্রচুর টাকাপয়সা খরচ করতে হয় এবং পরিবার সেই টাকার যোগান দেয়। এ থেকে সহজেই ধারণা করা যায়, এই অনুপ্রবেশকারীদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। তারা এই বিষয়টিকে দেখছে একপ্রকার বিনিয়োগ হিসেবে। আগে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবার জমি বা বাড়ি নির্মাণের জন্য অর্থলগ্নি করতো, এখন তারা নতুন খাত হিসেবে ইউরোপ প্রবেশকে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা যদিও বরাবরই বলে আসছেন, দারিদ্র্যের কারণে এই প্রবণতা বাড়ছে এবং দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়লে এটি কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক তৎপরতা ও উন্নয়ন যেমন বাড়ছে, সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতিবছর ইউরোপে অবৈধ অনুপ্রবেশের হারও।
আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের সমন্বয় প্রয়োজন। পাশাপাশি, দালালদের ও ভুয়া রিক্রুটিং এজেন্সির সদস্যদের গ্রেপ্তার ও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পরস্পরকে দোষারোপ না করে ইউরোপ এবং বাংলাদেশ উভয়কেই এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ