নারীদের জন্য পৃথিবীতে নরক হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান। হত্যা, নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ, চাকরির সুযোগ হারানোর পর এবার বিক্রি করা হচ্ছে দাস হিসেবে। ১৯৯৬ সাল থেকেই আফগানিস্তানের নারীদের পথচলা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি বন্ধুর। এক পা এগোলে দশ পা পিছিয়ে যেতে হয় তাদের। দেশের শাসনব্যবস্থা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় আফগান নারীর জীবনযাত্রা। চলার পথের প্রতিবন্ধকতাও বেড়ে যায়।
ক্ষমতা নেওয়ার পর নারীদের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তালিবান। তবে নারীদের ওপর এবার অন্যরকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তালিবান।
আজ রবিবার তালিবান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যেসব নারী দূরে কোথাও ভ্রমণ করতে চায় তাদের অবশ্যই কাছের কোন পুরুষ আত্মীয় থাকতে হবে। অন্যথায় তাদের কোন গাড়ি দেওয়া হবে না।
নতুন ইস্যু করা আইনে আরো বলা হয়েছে, গাড়ির মালিকেরা শুধু সেসব নারীদের গাড়ি সরবরাহ করতে পারবে যারা বোরকা পরিধান করবেন।
দেশটির মন্ত্রীর এক মুখপাত্র সাদেক আকিফ মুহাজির বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, যেসব নারী ৭২ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বের জায়গায় যেতে হলে কোন গাড়ি সরবরাহ করা উচিত হবে না যদি তাদের সঙ্গে কোন কাছের আত্মীয় না থাকে। এই মন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেন, অবশ্যই কাছের পুরুষ আত্মীয় হতে হবে।
নতুন এই নির্দেশনা তালিবান দেশটির সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। এর আগে তালিবান কর্তৃপক্ষ দেশটির নারী সাংবাদিকদের হিজাব পরার নির্দেশনা দেন।
এদিকে, তালিবানের ক্ষমতা গ্রহণের পর এ পর্যন্ত চাকরি হারিয়েছেন আফগানিস্তানের ৬৪০০ জন সাংবাদিক। আর চাকরি হারানো সাংবাদিকদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই নারী।
সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) ও আফগানিস্তানের সাংবাদিকদের সংগঠন আফগান ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (এআইজেএ) পরিচালিত এক যৌথ সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
জরিপে আরও জানা গেছে, সাংবাদিকদের চাকরি হারানোর পাশাপাশি বন্ধ হয়ে গেছে দেশটির ২৩১টি সংবাদমাধ্যম। সংস্থা দুটি জানিয়েছে, গত সাড়ে ৪ মাসে আফগানিস্তানের ৪০ শতাংশেরও বেশি সংবাদমাধ্যম বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি চাকরি হারিয়েছেন ৬০ শতাংশেরও বেশি সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মী।
আফগান নারীদের উত্থান-পতন
আফগানিস্তানে নারীদের বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে ১৯৯৬ সালে তালিবান প্রথম আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করার আগে কেমন ছিল আফগান নারীদের জীবন? অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক উইলিয়াম পোডলিচ ১৯৬৭ সালে ইউনেসকোর এক প্রকল্পের আওতায় দুই বছরের জন্য কাবুলের টিচার্স কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি ছিলেন শৌখিন আলোকচিত্রী। পোডলিচের তোলা ছবিগুলোয় তালিবানের ক্ষমতা দখলের আগের আফগান নারীদের জীবনযাত্রার আন্দাজ মেলে। সে সময়ের আফগান নারীরা পাশ্চাত্য পোশাকে অভ্যস্ত ছিলেন। নারী-পুরুষ একসঙ্গে বাসে যাতায়াত করতেন এবং শপিং মলে যেতেন। স্কুল-কলেজে নারীদের পড়াশোনা, গানবাজনা, খেলাধুলার ছবিও উঠে এসেছে পোডলিচের ক্যামেরায়।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালিবান শাসনামলে নারীদের জীবনযাপন বদলে যায়। ১৯৯৯ সালে তালিবান শাসনামলে থাকা এক নারীর বর্ণনায় উঠে আসে তাদের সে সময়ের কষ্টের জীবনের কথা। ফিব্রা নামের সেই নারীর বয়স এখন ৩২ বছর। থাকেন লন্ডনে। ১৯৯৯ সাল ছিল ফিব্রার শৈশবকাল। ফিব্রারা ছিলেন চার বোন ও এক ভাই। ফিব্রার বাবাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তালিবান। বাবাকে তারা আর ফিরে পাননি।
তালিবান শাসনামলে তাদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাবার খোঁজ করার সময় মাকেও মারধর ও হুমকি-ধমকি দেয় তালিবান। তালিবান শাসনের পতনের পর ফিব্রাদের পড়াশোনা আবার শুরু হয়। দুই দশক পর তালিবান ফিরে আসায় আফগানিস্তানে থাকা পরিবার নিয়ে এখন আবার উদ্বেগে রয়েছেন ফিব্রা।
২০০১ সালে তালিবান সরকারের পতনের পর নারীদের জীবনে আবারও বদল আসে। শুরু হয় নতুন পথচলা। নারীরা আবার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কর্মক্ষেত্রে বাড়ে নারীদের পদচারণ। সংগীত, চিত্রাঙ্কন ও খেলাধুলায় সাফল্যের ছাপ রাখতে শুরু করেন নারীরা। গণমাধ্যমেও নারীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি বাড়ে। ইউনেসকোর তথ্য অনুসারে, গত বছর আফগানিস্তানে শিক্ষার হার ছিল ৪৩। ২০১৭ সাল থেকে পরের দুই বছরে দেশটিতে শিক্ষার হার বেড়েছে ৮।
তালিবানের ক্ষমতা দখলের পরে দেশটির অর্থনীতি, কূটনীতি, শাসনপদ্ধতি, পররাষ্ট্রনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ দেখা দেয় আফগান নারীদের নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দেশ ও সংস্থা নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আর সেসব উদ্বেগ যে অমূলক নয়, তার প্রমাণও মিলতে শুরু করেছে। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে তালিবানের অন্তর্বর্তী সরকারের বেঁধে দেওয়া নানা নিয়মের বেড়াজালে আটকে পড়ছেন আফগান নারীরা।
তালিবানের নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় কোনো নারী সদস্য রাখা হয়নি। এমনকি নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভবনে নারী কর্মীদের ঢুকতে দিচ্ছে না তালিবান। তালিবান সরকারের নতুন শিক্ষামন্ত্রী আবদুল বাকি হাক্কানি আফগান নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পড়ার কথা জানিয়েছেন। শর্ত হলো তাদের হিজাব পরতে হবে। পুরুষদের সঙ্গে ক্লাস করার অনুমতি দেওয়া হয়নি নারীদের। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আলাদা ক্লাসের ও নারী শিক্ষকের বন্দোবস্ত করা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
তালিবান-নিযুক্ত আফগানিস্তানের খেলাধুলা ও শারীরিক শিক্ষাবিষয়ক দপ্তরের মহাপরিচালক জানান, দেশটিতে ৪০০ ধরনের খেলাধুলার অনুমোদন দেওয়া হবে। তবে এসব খেলায় নারীরা অংশ নিতে পারবেন কি না, তা স্পষ্ট করে জানাননি তিনি। এর মধ্যেই আফগানিস্তানের নারীদের ফুটবল দলের ৮০ জনের বেশি সদস্য পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছেন। ১৫ আগস্ট তালিবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগে কাবুল বিমানবন্দরে কাজ করতেন ৮০ জনের বেশি নারী। তবে এখন কাজে ফিরেছেন মাত্র ১২ জন।
জাতিসংঘের এক আফগান কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, আফগানিস্তানের কয়েকটি প্রদেশে নারীদের বাইরে বের হতে বাধা দিচ্ছে তালিবান। এমনকি নারীদের চাকরি ছাড়তেও বাধ্য করা হচ্ছে। শুধু খেলোয়াড় নন, আফগানিস্তান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন নারী অধিকারকর্মী, রাজনীতিক, গবেষক ও সাংবাদিকেরাও।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৩৫
আপনার মতামত জানানঃ