আরবের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ইয়েমেন। এর ওপর মধ্যপ্রাচ্যের মোড়ল সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট গত ছয় বছর ধরে দেশটির ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াইয়ে ইয়েমেনের কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে আরও লাখ লাখ মানুষ। দেশটির অবকাঠামো খাত প্রায় ধ্বংসের মুখে। এদিকে ইয়েমেনে সৌদি জোটের বিভিন্ন রকম হামলা অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র ইয়েমেনের রাজধানী সানার একটি বিমানবন্দরে আক্রমণ চালিয়েছে। জোটের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ইয়েমেনি সৈন্যরা দীর্ঘদিন যাবত আন্তঃ সীমান্ত বিমান হামলা চালানোর কাজে বিমানবন্দরটিকে ব্যবহার করত।
২০১৪ সাল থেকে ইয়েমেনে ইসলামপন্থি বিদ্রোহীদের সঙ্গে দেশটির সরকারের গৃহযুদ্ধ চলছে। বিদ্রোহী বাহিনী গত কয়েক বছর ধরে বিমানবন্দরটি নিজেদের দখলে রেখেছে। একইসঙ্গে বিমানবন্দরটি জাতিসংঘ নেতৃত্বাধীন মানবিক ত্রাণ সহায়তার প্রধান কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, ইয়েমেনে বিমান হামলার আগে সামরিক জোট জাতিসংঘের কাছে আহ্বান জানিয়েছিল যাতে নিজেদের কর্মীদের ওই এলাকা থেকে সরিয়ে নেয় সংস্থাটি। এতে আরো বলা হয়, বিমান হামলার সময় নির্দিষ্ট কয়েকটি সাইট অর্থাৎ কিছু চিহ্নিত সামরিক স্থাপনাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল।
সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের একজন মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল টার্কি আল-মালকি বলেছেন, বিমান হামলায় ছয়টি লক্ষবস্তু, বিশেষ করে যেসব জায়গা থেকে ড্রোন ব্যবহার করে হামলা চালানো হতো, ড্রোন চালানো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন এমন মানুষজনের বাড়িঘর এবং যেসব জায়গায় ড্রোন রাখা হয় সেসব স্থান লক্ষ্য করে এই স্ট্রাইক চালানো হয়েছে। তবে কোন পক্ষই এখনও হামলার বিস্তারিত প্রকাশ করেনি।
বিদ্রোহী বাহিনী দেশটির কেন্দ্রীয় শহর মারিব এবং উপকূলীয় শহর হোদেইদাকে টার্গেট করেছে। অন্যদিকে জোট রাজধানী সানা এবং অন্যান্য বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাতে বিমান হামলা বাড়িয়ে দিয়েছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একবার মারিব দখলে অভিযান চালিয়েছিল হুথি বিদ্রোহীরা, যদিও সেবার বিপুল সংখ্যক যোদ্ধার প্রাণহানি হওয়ায় কয়েক মাস স্থগিত ছিল তাদের সেই দখল অভিযান। গত ২৩ সেপ্টেম্বর ইয়েমেনের পূর্বাঞ্চলীয় মারিব প্রদেশ হুথি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
সৌদি জোট বলছে, হুথিদের দখলে যাওয়ার পর থেকে এই প্রদেশে বেসামরিক নাগরিকদের চলাচল এবং মানবিক ত্রাণ সহায়তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১৫ সালের শুরুর দিকে হুথি বিদ্রোহীদের হামলার মুখে সৌদি-সমর্থিত ইয়েমেনের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আব্দ রাব্বু মনসুর আল হাদি ক্ষমতা ছেড়ে সৌদি আরবে পালিয়ে যান। ক্ষমতাচ্যুত এই প্রেসিডেন্টকে ফেরাতে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ইয়েমেনে হুথিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে দেশটির হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছেন এবং এ গৃহযুদ্ধ প্রতিযোগী আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে একটি ‘প্রক্সি’ যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
বিতর্কিত সেই অভিযানের শুরুর পর ইয়েমেনের রাজনৈতিক সংকটের অবসান হওয়ার পরিবর্তে তা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বর্তমানে ইয়েমেনে কার্যত দুই শাসক গোষ্ঠী সক্রিয় আছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক সহযোগিতার ওপর ভর করে দেশটির দক্ষিণাঞ্চল এখনো মনসুর হাদির নেতৃত্বাধীন সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, অপর দিকে উত্তরাঞ্চল সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে হুথি বিদ্রোহীরা।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনে প্রায় ছয় বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে। দেশটির বিভিন্ন অংশে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বলা হয়ে থাকে, ইয়েমেনের যুদ্ধের আড়ালে আদতে লড়াই চলছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে। ওদিকে আবার সৌদি আরব ও ইরানের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো পরাশক্তিরা। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনীতির কলকাঠি নাড়ছে ইসরায়েল। ইয়েমেনের হাউছি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আবদুল মালিক আল-হাউছির দাবি, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের দেশগুলো গোপনে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা করছে। তারা মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাতে লিপ্ত। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে সৌদি আরবের শাসকরা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোট করেছে।
উল্লেখ্য, ইয়েমেনের এই সংঘাতকে মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্যের লড়াইয়ে সৌদি-ইরানের ‘ছায়াযুদ্ধ’ হিসেবে দেখা হয়। টানা গৃহযুদ্ধ ও সংঘাত চলার ফলে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এবং এক সময়ের সচ্ছল এই রাষ্ট্র।
জাতিসংঘ বলছে, ইয়েমেনের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ খাদ্য ও ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের গুরুতর সংকটে ভুগছেন।
২০১৪ সাল থেকে ইয়েমেনে ইসলামপন্থি বিদ্রোহীদের সঙ্গে দেশটির সরকারের গৃহযুদ্ধ চলছে। বিদ্রোহী বাহিনী গত কয়েক বছর ধরে বিমানবন্দরটি নিজেদের দখলে রেখেছে। একইসঙ্গে বিমানবন্দরটি জাতিসংঘ নেতৃত্বাধীন মানবিক ত্রাণ সহায়তার প্রধান কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
জাতিসংঘের নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের শেষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মিলে সৌদি জোটের সঙ্গে যুদ্ধরত ইয়েমেনে মৃত্যু তিন লাখ ৭৭ হাজারে দাঁড়াবে। দেশটিতে ২০৩০ সালের মধ্যে সংঘাত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কারণে প্রায় ১৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
ইউএনডিপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চলতি বছরের শেষে ইয়েমেনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৩ লাখ ৭৭ হাজারে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু। মূলত বিমান হামলা ও সংঘাতের মতো প্রত্যক্ষ এবং সংক্রামক রোগ, ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের মতো পরোক্ষ কারণে দেশটিতে মৃত্যুর এসব ঘটনা দেখা যেতে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে ইউএনডিপি বলেছে, ৬০ শতাংশ মৃত্যু ঘটতে পারে পরোক্ষ কারণে।
এ বিষয়ে ইউএনডিপি’র কর্মকর্তা আচিম স্টেইনার বলেন, ‘ইয়েমেনে যুদ্ধের ময়দানের তুলনায় রোগ-ক্ষুধায় বেশি মানুষের মৃত্যুর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা যুদ্ধ ক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে।এটা ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকট। এই সংকট নিরসনে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।’
যুদ্ধে ইয়েমেনে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে বলে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘ। ইতোমধ্যে কয়েক লাখ মানুষ মারা গেছেন। দেশটির দেড়কোটিরও বেশি মানুষ চরম দারিদ্রের মধ্যে বসবাস করছেন।
ইউএনডিপির নতুন প্রতিবেদনে ধারণা করা হয়েছে, বিবদমানপক্ষগুলোর মধ্যে ২০২২-এর জানুয়ারি মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তিতে পৌঁছাতে পারে তবে ইয়েমেনিরা ২০৪৭ এর মধ্যে দারিদ্র দূর করতে পারবে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুদ্ধের ফলে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অপুষ্টির শিকার ইয়েমেনের নারী ও শিশুরা। তীব্র অপুষ্টির শিকার ১২ লাখ নারী ও ২৩ লাখ শিশুর জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রয়োজন। এর মধ্যে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ঝুঁকিতে আছে চার লাখ শিশু।
সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসেবে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তীব্র অপুষ্টিতে মারা গেছে ৮৫ হাজার শিশু। জাতিসংঘের হিসেবে দেশটির এক কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষ থেকে মাত্র এক কদম দূরে রয়েছে।
প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের সুবিধা না পাওয়ায় ২০১৭ সালে ইয়েমেনে ভয়ংকর রূপে ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা রোগ। ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশটিতে কলেরায় সাত হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। অথচ সৌদি আরব যুদ্ধ বন্ধ তো দূরের কথা এক প্যাকেট স্যালাইনও ইয়েমেনে পাঠায়নি।
ইয়েমেনের মানবিক পরিস্থিতির বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। যদি চলতি বছরে জরুরিভিত্তিতে যথাযথ সহায়তা করা না যায় তাহলে ইয়েমেন মৃত্যুকূপে পরিণত হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। ইয়েমেনে সহায়তার জন্য যে পরিমাণ অর্থ জাতিসংঘ চেয়েছে তার অর্ধেক দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দাতারা। তারপরই এমন সতর্ক করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
গুতেরেস বলেন, লাখ লাখ ইয়েমেনি শিশু, নারী এবং পুরুষের বেঁচে থাকার জন্য জরুরিভিত্তিতে সহায়তা প্রয়োজন। এই সহায়তা যদি কমানো হয় তাহলে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে দাতারা যে সাড়া দিয়েছেন তাকে ‘হতাশাজনক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘ প্রধান।
গুতেরেস জানিয়েছেন, সাহায্যের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া মানে, ইয়েমেনের মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া। লক্ষ্য ছিল ৩৮৫ কোটি ডলার তোলার। মোট একশটি দেশের কাছ থেকে এই অর্থ জোগাড় করা হচ্ছিল। জাতিসংঘের মতে, মানবিক সমস্যা সমাধানের জন্য এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে মাত্র ১৭০ কোটি ডলার উঠেছে।
তাই গুতেরেস জানিয়েছেন, পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক। ২০১৯ সালে দেশগুলি ইয়েমেনকে সাহায্য করার জন্য যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা তারা রাখেনি। ফলে ইয়েমেনে মানুষের অবস্থা ভয়াবহ। সেখানে শৈশব নারকীয়। তাদের না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। তাই গুতেরেসের আবেদন, সব দেশই আবার বিষয়টি ভেবে দেখুক এবং প্রতিশ্রুত অর্থ দিক। না হলে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ থেকে ইয়েমেনকে বাঁচানো যাবে না।
জাতিসংঘের হিসাব, এই বছর দেশের এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ না খেয়ে থাকবেন। পাঁচ বছরের কম বয়সী চার লাখ শিশু না খেতে পেয়ে মারা যেতে পারে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংঘাতজর্জর দেশটিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যতদিন যাচ্ছে ততই ইয়েমেন সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আর বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের ফলে দেশটি বর্তমানে ইতিহাসের চরম মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে। অচিরেই এই যুদ্ধ থামানো না গেলে বিশ্ব একটি মানব সভ্যতাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫২
আপনার মতামত জানানঃ