আফগানিস্তান দখলের পর থেকে তালিবানরা ক্ষমা প্রার্থনা করে নানারকম প্রতিশ্রুতি দিলেও তাদের শাসন প্রক্রিয়া কট্টরপন্থী আফগান নাগরিকরা অতিষ্ট হয়ে আছেন। বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তালিবান তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। তাদের বিরুদ্ধে বেসামরিক লোকজনদের রাস্তাঘাটে হত্যা, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা এবং মুখ খোলার জন্য নারীদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে।
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার বলা হয়েছে, তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ এসেছে যে, আফগানিস্তানে শতাধিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে তালিবান জড়িত। সংস্থাটির মানবাধিকার বিষয়ক উপ-প্রধান নাদা আল-নাশিফ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে এই তথ্য তুলে ধরেছেন। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি এখবর জানিয়েছে।
নাদা আল-নাশিফ জানান, ১৫ আগস্টের পর থেকে তালিবান শাসনে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও এসব হত্যাকাণ্ড উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী ও আগের সরকার সংশ্লিষ্ট শতাধিক সাবেক সদস্যকে হত্যার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এসব হত্যাকাণ্ডের অন্তত ৭২টিতে তালিবান জড়িত ছিল।
তিনি আরও বলেন, একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতদের লাশ প্রকাশ্যে প্রদর্শন করা হয়েছে। এতে জনগণের মনে ভয় ধরিয়েছে।
মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিবেদনে ৪৭টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সমালোচনার পর এই মন্তব্য করলেন নাদা আল-নাশিফ। আফগানিস্তানের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত তথ্য জানানোর অংশ হিসেবে তিনি এই মন্তব্য করেন।
এদিকে তালিবান মুখপাত্র কারি সায়েদ খোস্তি এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগকে তিনি প্রমাণের ভিত্তিতে করা হয়নি বলে দাবি করেছেন।
গত মধ্য আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর তালিবান নেতারা ক্ষমতাচ্যুত আফগান সরকার এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমা করে দেওয়া এবং তাদের ওপর প্রতিশোধ না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশটির সাবেক নিরাপত্তা বাহিনীর শতাধিক সদস্যকে হত্যা অথবা গুম করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) নতুন প্রতিবেদনে দেশটির চারটি প্রদেশের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী ও আগের সরকার সংশ্লিষ্ট শতাধিক সাবেক সদস্যকে হত্যার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এসব হত্যাকাণ্ডের অন্তত ৭২টিতে তালিবান জড়িত ছিল।
সংস্থাটি বলেছে, তালিবান নেতারা ক্ষমতাচ্যুত আফগান সরকার এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমা করে দেওয়া এবং তাদের ওপর প্রতিশোধ না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও স্থানীয় তালিবান কমান্ডাররা সাবেক ওইসব সেনা ও পুলিশ সদস্যকে হত্যার নিশানা করেছে।
গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালিবানের হাতে চলে যায়। এর আগে দেশ ছেড়ে পালান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। কাবুল দখলের পর তালিবান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, যারা সরকারের পুলিশ, সেনাবাহিনী কিংবা বিভিন্ন প্রদেশেও কাজ করেছেন, তারা তালিবান সরকারের আমলে নিরাপদে থাকবেন। যদিও এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর থেকেই তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। কারণ, দেশটির সাধারণ মানুষ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যার রেকর্ড রয়েছে তালিবানের। বিশেষ করে ২০২০ সালের শুরু থেকে চলতি বছর ক্ষমতা দখলের আগপর্যন্ত প্রায় ১৮ মাসে বেশ কিছু নৃশংস হামলা চালায় তালিবান। এসব হামলার ভুক্তভোগীদের মধ্যে রয়েছেন বিচারক, সাংবাদিক, অধিকারকর্মীও।
এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তালিবান ক্ষমতা দখলের পরও অব্যাহত ছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তালিবান ক্ষমতায় আসার আগে দিয়ে তাদের সমালোচনায় মুখর হতে পারে এমন মানুষদের নির্মূল করা এবং বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য ওই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
এইচআরডব্লিউ বলেছে, তালিবান ক্ষমতা নেওয়ার পর আদেশ দিয়েছিল, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে নিবন্ধন করুন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যে চিঠি দেওয়া হচ্ছে, তা সংগ্রহ করুন। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো। আত্মসমর্পণ করে নিবন্ধনের পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অনেকে সেখানে গুম হয়েছেন বা তাদের হত্যা করা হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, তালিবান তাদের পূর্ববর্তী সরকারের বিভিন্ন নথি ধরে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের খুঁজে বের করে হত্যা অথবা গুম করেছে।
গত আগস্টে ক্ষমতা দখলের পর তালিবান একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পশতুন নৃগোষ্ঠীর সুন্নি আলেম প্রভাবিত একটি পুরুষ মন্ত্রিসভা বেছে নিয়েছে তারা। প্রতিশোধমূলক হত্যা, সাংবাদিকদের উপর হামলা, নারী অধিকার হরণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তালিবানের বিরুদ্ধে।
তালিবানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। দেশটির সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালিয়েছে গোষ্ঠীটি। আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের কমপক্ষে ১৩ সদস্যকে হত্যা করেছে দেশটির ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালিবান।
তবে চলতি বছর হাজারাদের ওপর তালিবানের চালানো হত্যাকাণ্ড এটিই প্রথম নয়। গত ১৯ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, আফগানিস্তান দখলে নেওয়ার আগে গত জুলাই মাসে দেশটির গজনি প্রদেশে হাজারা সম্প্রদায়ের ৯ ব্যক্তিকে হত্যা করে তালিবান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত জঙ্গিপ্রবণ আফগানিস্তানে হাজারারা নিষ্পেষিত— এ কথা প্রমাণ দিয়ে বলা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এমন আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে আসলে কারা সুরক্ষিত? কেউ নয়। জোর দিয়ে বলা যায়, যত দিন ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যা বন্ধ না হবে, ততদিন শান্তি ফিরবে না আফগান মুল্লুকে। আর ততদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না হাজারারা। ফলে শান্তির জন্য আফগানিস্তানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বহু বিভক্ত আফগানিস্তানে সেই সম্প্রীতি কবে হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৩
আপনার মতামত জানানঃ