মঙ্গোলরাই ধ্বংস করেছিল ইসলামি স্বর্ণযুগের অজস্র নগর-জনপদ। মঙ্গোলিয়ার স্তেপ প্রান্তরের দুধর্ষ এই ঘোড়াসওয়ার ও যোদ্ধা জাতি চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল ইসলামি সভ্যতার বুকে। সে সময়ের অনেক আলেম মঙ্গোলদের বাইবেল ও কোরানে বর্ণিত ইয়াজুজ-মাজুজ জাতি মনে করেছিলেন। আবার তারাই গ্রহণ করেছিল ইসলাম ধর্ম। কেন?- সেই ইতিহাসই জানবো আজ।
বর্বর ছিল মঙ্গোলরা। ওই সময় খারেজম সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধ নগর উরগঞ্জ মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এজন্য নগরটি পতনের পর সমস্ত অধিবাসীদের হত্যার নির্দেশ দেন চেঙ্গিস খান। প্রায় ৫০ হাজার মঙ্গোল সেনার প্রত্যেকে অন্তত ২৪ জন করে নগরবাসীকে হত্যা করে। শুধু উরগঞ্জেই মোট ১২ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল গ্রেট খানের সেনাবাহিনী।
উরগঞ্জের পতনের পর চেঙ্গিসের পুত্র তলুই খান ইসলামি সভ্যতার আরেক সমৃদ্ধ নগর মার্ভ অবরোধ করেন। মার্ভের গভর্নর ছিলেন মুজির আল মুলক। তিনি মঙ্গোলদের কাছে বিনা-লড়াইয়ে নগর সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। তার আগে তলুই নগরবাসীকে রেহাই দেওয়ার শর্তও মেনে নেন। কিন্তু, শহরের নিয়ন্ত্রণ পাওয়া মাত্রই ভুলে যান সেই অঙ্গীকার।
৪০০ মুসলিম কারিগর, শিল্পী, প্রকৌশলীকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়। নারী ও শিশুদের দাস বানিয়ে নিয়ে যায় তার সেনারা, বাকি অধিবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়।
এরপর ইসলামি সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু বাগদাদের পতনও হয় মঙ্গোলদের হাতেই। তাদের চতুর রণকৌশলের সামনে সমূলে বিনাশ হয় খারেজম ও আব্বাসীয় প্রতিরোধ। তাই সেই মঙ্গোলদের ইসলাম গ্রহণ ছিল ইতিহাসের বড় দিকপরিবর্তন। ইতিহাসে যদিও পরাজিত জাতির সংস্কৃতি ও ধর্ম বিজেতা জাতির গ্রহণ করার ঘটনা একেবারেই বিরল নয়, তবুও মঙ্গোলদের ইসলাম গ্রহণ ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সেকালের মুসলিমরা মনে করতো, মঙ্গোল নেতৃত্ব ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে পরিকল্পিতভাবে মুছে দিতে চেয়েছিল।
১৩ শতকের শেষদিকে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে বাসকারী মঙ্গোলরা প্রথম ইসলাম ধর্মগ্রহণ করা শুরু করে। এমনকি এক পর্যায়ে এসে চেঙ্গিস খানের অনেক বংশধর মঙ্গোল আইন ‘ইয়াসা’র চেয়ে শরিয়াকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। পশ্চিম এশিয়া ও কৃষ্ণ সাগর তীরবর্তী মঙ্গোল শাসক ও তাদের অনুসারীদের ইসলাম গ্রহণের কারণ ছিল বহুবিধ।
তবে অন্যতম কারণ ছিল নৈকট্য। চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর তার বিশাল সাম্রাজ্য কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এরমধ্যে পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার গোল্ডেন হর্ড, ইলখানাতে এবং চাগাতাই খানাতের অধিকাংশ প্রজাই ছিল মুসলমান। এই অঞ্চলের সুফি ও আলেমরা ছিলেন আধ্যাত্মিক ও সামাজিক নেতা। বিভিন্ন কারণে প্রায়ই তাদের সংস্পর্শে আসতেন মঙ্গোল শাসকবর্গ এবং সেনাপতিরা।
সে সময় উচ্চপদস্থ মঙ্গোলদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করতেন বৌদ্ধ এবং খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারকরাও। তবে মুসলিম প্রচারকদের মতো তাদের স্থানীয় জনসংখ্যার মধ্যে বড় সমর্থন ছিল না। মঙ্গোল শাসকরা এই সমর্থনের গুরুত্ব ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেন। ইলখানাতে এবং চাগাতাই খানাতের অধিকাংশ মঙ্গোলই বৌদ্ধ বা খ্রিস্টানদের চেয়ে মুসলমান জনসংখ্যার সংস্পর্শেই আসতো বেশি। ফলে বেশিরভাগ সাধারণ মঙ্গোলের ইসলাম ধর্মগ্রহণ করাটাই ছিল স্বাভাবিক। চীনের ইউনান রাজবংশেও একইরকম নৈকট্যের কারণে মঙ্গোলদের চৈনিকিকরণ শুরু হয়েছিল।
তাছাড়া, বিভিন্ন পেশায় মুসলমানদের দক্ষতা মঙ্গোলদের কাছে তাদের গুরুত্ব তুলে ধরে। মুসলমান কারিগর, প্রকৌশলী, শিল্পী, প্রশাসক, চিকিৎসকদের সমস্ত মঙ্গোল সাম্রাজ্য জুড়ে নিয়োজিত করা হয়। মঙ্গোল সেনাপতি ও খানদের সাথে তারা বিভিন্ন যুদ্ধাভিযানে অংশ নিয়ে যুদ্ধাস্ত্র তৈরি, চিকিৎসা, যুদ্ধ চিত্রাঙ্কন, মানচিত্র তৈরিসহ অনেক পেশায় দায়িত্ব পালন করেন।
অনেক মুসলিম প্রশাসক স্থানীয় সেনাবাহিনী গঠন করে নিজ খানের জন্য যুদ্ধ করেছেন। সুযোগ্য কারো কারো অধীনে খোদ মঙ্গোল বাহিনীর একাংশের নিয়ন্ত্রণ দেওয়ারও নজির রয়েছে। মধ্য এশিয়ার তুর্কি এবং ইরানি বংশদ্ভূত মুসলিমরা মঙ্গোল শাসকদের এমন বহুবিধ দায়িত্ব পালন করে, জনশক্তি যোগান দিয়ে মঙ্গোলদের সাহায্য করেছে।
চেঙ্গিসের পুত্র ওগাদেই খানের শাসনামল নাগাদ উচ্চপদস্থ আমলাদের অনেকেই ছিলেন মুসলমান। মধ্য এশিয়া ও চীন শাসনের জন্য মঙ্গোলরা যে মন্ত্রণালয় গঠন করে তার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মাহমুদ ইয়ালাভাচ, তার ছেলে মাসউদ বেগ এবং আবদ আল-রাহমান। তাদের পদমর্যাদা এতই বড় ছিল যে, একমাত্র গ্রেট খান বা সম্রাট ছাড়া অন্য কারো কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হতো না।
শুধু ওগাদেই এর আমলে নয়, তার বাবা চেঙ্গিস খানের দরবারেও অনেক মুসলমান বিচারক থাকার ঘটনা ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে।বমঙ্গোল রাজন্যরা আর্থিক ব্যবস্থায় দক্ষ মুসলিম বণিকদের সমাদর করতেন। যোগ্যতা প্রমাণ করলে মিলতো বিপুল পুরস্কারসহ পুরো সাম্রাজ্য জুড়ে ব্যবসা করার ছাড়পত্র ‘ওরটগ’।
১২৪০ এর দশকে অভিজাত মঙ্গোল ও তাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ইসলাম গ্রহণের নজির দেখা যায়। তবে নতুন ধর্মগ্রহণকারী প্রথম প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন অমঙ্গোলিয় ‘করগুজ’ নামের একজন উইঘুর। ওগাদেই খান তাকে পশ্চিম এশিয়া বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন।
১২৪১ সালে বাতু খানের সাথে হাঙ্গেরি দখলের অভিযানে গিয়েছিলেন অনেক মুসলিম। মোহির বিখ্যাত যুদ্ধের আগে নিজ শিবিরের মুসলিমদের যুদ্ধ জয়ের প্রার্থনা করার আহ্বান জানান বাতু। এসব মুসলমানরা মধ্য এশিয়ার স্থানীয়দের মধ্যে থেকে গঠিত সেনাদল, নাকি ধর্মান্তরিত মঙ্গোল; সেবিষয়ে স্পষ্ট জানা যায় না।
সাধারণ সেনাদের ইসলাম গ্রহণের আরেকটি কারণ ছিল পরিবার থেকে দূরে থাকা। যেমন মঙ্গোলরা নতুন এলাকা দখল করে সেখানে শাসন দৃঢ় করতে ‘টামা’ নামক সেনা ইউনিট সেখানে রাখতো। টামায় থাকা সৈন্যরা স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে আসার অনুমতি পেত না। এভাবে মাতৃভূমি মঙ্গোলিয়া থেকে দূরদূরান্তে থাকা অনেক সেনা সাংস্কৃতিক শূন্যতা অনুভব করতো। তারা স্থানীয় মুসলমান নারীদের বিয়ে করা শুরু করে। এভাবে তাদের স্তেপ সংস্কৃতির সাথে দূরত্ব আরো বাড়তে থাকে, সে তুলনায় ইসলামের সাথে দূরত্ব হ্রাস পায়।
বৈবাহিক সম্পর্ক, সুফি এবং স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাবে নিজ সেনাদের ধীরে ধীরে এভাবে ইসলাম গ্রহণ বাড়তে দেখে অনেক সেনাপতি বা শাসক ইসলাম গ্রহণ করেন। এমন একজন সেনাপতি ছিলেন তামাচি বাইজু। তিনি ১২৪০ এর দশকের শুরু থেকে ৬০ এর দশক পর্যন্ত ককেশাস ও আনাতোলিয়া অঞ্চলে নিয়োজিত ছিলেন। এই দুই দশকের ঐতিহাসিক অনেক বর্ণনায় তার শিবিরে মুসলিম সুফি, আলেম, প্রশাসক এবং উপদেষ্টার আসা-যাওয়ার কথা জানা যায়। তার অনেক সেনাও ইসলাম গ্রহণ করছিল। জীবনের শেষদিকে বাইজু নিজেও ইসলাম গ্রহণ করেন। মৃত্যুর পর তাকে যেন মুসলমানদের মতো গোসল করিয়ে ইসলামি রীতিতে কবর দেওয়া হয়, এমন ইচ্ছের কথা অনুসারীদের জানিয়েছিলেন।
তবে সবচেয়ে বিখ্যাত ধর্মান্তরিত ছিলেন বার্কে খান। ককেশাস অঞ্চলের দখল নিয়ে তিনি নিজের চাচাতো ভাই হুলাগুর সাথেও যুদ্ধ করেছেন। তবে তিনি কীভাবে মুসলমান হন, তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। কেউ কেউ বলেন, তিনি পারিবারিক সূত্রে মুসলিম ছিলেন। আবার কিছু সূত্রে বলছে, তিনি বিখ্যাত সুফি সাধক শেখ সাইফ আল-দ্বীন বাখারজির চেষ্টায় ধর্ম পরিবর্তন করেন।
তবে ১২৫০ সাল নাগাদ বার্কে যে সত্যিকার অর্থেই মুসলিম হয়েছিলেন, সে ব্যাপারে একাধিক স্বতন্ত্র সূত্রে উল্লেখ রয়েছে। মিশরের মামলুক সুলতানদের সাথে দূত বিনিময়েও তার ইসলাম গ্রহণের উল্লেখ রয়েছে। মামলুক রাজদূতরা ফিরে এসে সুলতানকে জানিয়েছেন, বার্কে ধর্ম পরিবর্তন করলেও মঙ্গোলদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকই পরেন।
মঙ্গোলদের সাম্রাজ্য গত হয়েছে বহুদিন। আদিগন্ত স্তেপ বা সমভূমির সেই প্রান্তরের দেশ মঙ্গোলিয়ায় আজ মোট জনসংখ্যার ৩-৫ শতাংশ মুসলিম। অর্থাৎ ইসলাম শুধু সাম্রাজ্যের দূরপ্রান্তে নয়, খোদ মূল জনপদেও প্রসারিত হয়েছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/২০১০
আপনার মতামত জানানঃ