গত মধ্য আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর তালিবান নেতারা ক্ষমতাচ্যুত আফগান সরকার এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমা করে দেওয়া এবং তাদের ওপর প্রতিশোধ না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশটির সাবেক নিরাপত্তা বাহিনীর শতাধিক সদস্যকে হত্যা অথবা গুম করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) নতুন প্রতিবেদনে দেশটি চারটি প্রদেশের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
সংস্থাটি বলেছে, তালিবান নেতারা ক্ষমতাচ্যুত আফগান সরকার এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমা করে দেওয়া এবং তাদের ওপর প্রতিশোধ না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও স্থানীয় তালিবান কমান্ডাররা সাবেক ওইসব সেনা ও পুলিশ সদস্যকে হত্যার নিশানা করেছে।
এইচআরডব্লিউ’র ‘নো ফরগিভনেস ফর পিপল লাইক ইউ: এক্সেকিউশনস এন্ড এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন আফগানিস্তান আন্ডার তালিবান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ অগাস্ট থেকে ৩০ অক্টোবরের মধ্যে আফগানিস্তানের চারটি প্রদেশে ১০০ জনের বেশি খুন হয়েছে এবং ৪৭ জন গুম হয়েছে।
এদের মধ্যে আছে— আফগান ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্সেস (এএনএসএফ) এর সাবেক সদস্য, পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক কর্মকর্তারা এবং মিলিশিয়ারা।
সংস্থাটি অভিযোগ করেছে, আফগান পুলিশ ও সেনাদের হত্যার ক্ষেত্রে স্থানীয় কমান্ডারদের এমন কর্মকাণ্ড মেনে নিয়েছেন ও অনুমোদন দিয়েছেন তালিবানের শীর্ষ নেতৃত্ব। আর এ কাজ ইচ্ছাকৃত। যদিও তালিবানের এক মুখপাত্র এমন প্রতিশোধমূলত কর্মকাণ্ডের কথা অস্বীকার করেছেন।
গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালিবানের হাতে চলে যায়। এর আগে দেশ ছেড়ে পালান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। কাবুল দখলের পর তালিবান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, যারা সরকারের পুলিশ, সেনাবাহিনী কিংবা বিভিন্ন প্রদেশেও কাজ করেছেন, তারা তালিবান সরকারের আমলে নিরাপদে থাকবেন। যদিও এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর থেকেই তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। কারণ, দেশটির সাধারণ মানুষ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যার রেকর্ড রয়েছে তালিবানের। বিশেষ করে ২০২০ সালের শুরু থেকে চলতি বছর ক্ষমতা দখলের আগপর্যন্ত প্রায় ১৮ মাসে বেশ কিছু নৃশংস হামলা চালায় তালিবান। এসব হামলার ভুক্তভোগীদের মধ্যে রয়েছেন বিচারক, সাংবাদিক, অধিকারকর্মীও।
এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তালিবান ক্ষমতা দখলের পরও অব্যাহত ছিল। গত মঙ্গলবার এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এইচআরডব্লিউ বলেছে, গজনি, হেলমান্দ, কুন্দজ ও কান্দাহার প্রদেশে এক শর বেশি মানুষকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করেছে তালিবান। তালিবান ক্ষমতা গ্রহণের পরই এসব হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তালিবান ক্ষমতায় আসার আগে দিয়ে তাদের সমালোচনায় মুখর হতে পারে এমন মানুষদের নির্মূল করা এবং বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য ওই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
তালিবান তাদের পূর্ববর্তী সরকারের বিভিন্ন নথি ধরে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের খুঁজে বের করে হত্যা অথবা গুম করেছে।
এইচআরডব্লিউ বলেছে, তালিবান ক্ষমতা নেওয়ার পর আদেশ দিয়েছিল, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে নিবন্ধন করুন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যে চিঠি দেওয়া হচ্ছে, তা সংগ্রহ করুন। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো। আত্মসমর্পণ করে নিবন্ধনের পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অনেকে সেখানে গুম হয়েছেন বা তাদের হত্যা করা হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, তালিবান তাদের পূর্ববর্তী সরকারের বিভিন্ন নথি ধরে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের খুঁজে বের করে হত্যা অথবা গুম করেছে।
গত আগস্টে ক্ষমতা দখলের পর তালিবান একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পশতুন নৃগোষ্ঠীর সুন্নি আলেম প্রভাবিত একটি পুরুষ মন্ত্রিসভা বেছে নিয়েছে তারা। প্রতিশোধমূলক হত্যা, সাংবাদিকদের উপর হামলা, নারী অধিকার হরণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তালিবানের বিরুদ্ধে।
তালিবানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। দেশটির সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালিয়েছে গোষ্ঠীটি। আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের কমপক্ষে ১৩ সদস্যকে হত্যা করেছে দেশটির ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালিবান।
তবে চলতি বছর হাজারাদের ওপর তালিবানের চালানো হত্যাকাণ্ড এটিই প্রথম নয়। গত ১৯ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, আফগানিস্তান দখলে নেওয়ার আগে গত জুলাই মাসে দেশটির গজনি প্রদেশে হাজারা সম্প্রদায়ের ৯ ব্যক্তিকে হত্যা করে তালিবান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত জঙ্গিপ্রবণ আফগানিস্তানে হাজারারা নিষ্পেষিত— এ কথা প্রমাণ দিয়ে বলা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এমন আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে আসলে কারা সুরক্ষিত? কেউ নয়। জোর দিয়ে বলা যায়, যত দিন ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যা বন্ধ না হবে, ততদিন শান্তি ফিরবে না আফগান মুল্লুকে। আর ততদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না হাজারারা। ফলে শান্তির জন্য আফগানিস্তানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বহু বিভক্ত আফগানিস্তানে সেই সম্প্রীতি কবে হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ