প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যে পরিমাণ অঞ্চল দখলে নিতে জার্মানির সময় লেগেছিল প্রায় তিন বছর, সেটাই হিটলার করে দেখিয়েছিলেন মাত্র ৬ মাসে। যেন জাদুকরের ভেলকি; তাক লেগে গিয়েছিল গোটা বিশ্বের। তবে কি শুধু প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে থাকার কারণেই এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিলেন হিটলার? এর উত্তর আগাগোড়া মুড়ে আছে রহস্যের চাদরে।
সে রহস্য জানতে চলুন ঘুরে আসা যাক ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। জার্মানির নাৎসি বাহিনী পোল্যান্ড অধিগ্রহণ করেছে। ওর ঠিক পরপরই জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল ফ্রান্স। কিন্তু যুদ্ধে ফ্রান্স পেরে উঠলো না হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে। অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই ধীরে ধীরে পিছু হঠতে শুরু করল ফ্রান্সের ফ্রন্টলাইন।
আর এরপরই ঘাতক জার্মান ঐতিহাসিক আক্রমণ। আর্দেনস পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সের মধ্যে ঢুকে পড়ল জার্মান সেনারা। ১৯৪০ সালের ২৫ জুন মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে জয় ছিনিয়ে নিল জার্মানি। ফ্রান্সের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তো বটেই, বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডেরও বেশ কিছু অংশের দখল চলে যায় হিটলারের হাতে।
কীভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন হিটলার? শুধু কি উন্নত অস্ত্র এবং যুদ্ধের কৌশল? না, হিটলার বুঝতে পেরেছিলেন যুদ্ধজয়ের প্রথম শর্তই হল সেনাবাহিনীর কর্মক্ষমতা। তারা যন্ত্রণা, কষ্ট ও প্রাকৃতিক চরমাবস্থা সহ্য করে একটানা লড়াই করে যেতে পারলেই আসবে কাঙ্ক্ষিত জয়। আর সেই জায়গাটাতেই কাজ করেছিলেন হিটলার। সৈন্যদের চাঙ্গা রাখতে ব্যবহার শুরু করেছিলেন ‘ম্যাজিক পিল’-এর।
কিন্তু কী এই ম্যাজিক পিল? আজ এই ম্যাজিল পিলকে আমরা চিনি মেথামফেটামিন বা সহজ ভাষায় মেথ হিসাবে। ল্যাবরেটরিত তৈরি এক ধরনের সিন্থেটিক স্ফটিক এই ওষুধ। এই সিন্থেটিক ড্রাগ মূলত সজাগ করে রাখে মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে। ক্লান্তি, ঘুম, খিদের মতো অনুভূতিগুলিকে কমিয়ে বাড়িয়ে দেয় দেহের অ্যাড্রিনালিন হরমোনের ক্ষরণ। ফলে সার্বিকভাবে বৃদ্ধি পায় কর্মক্ষমতা।
নাৎসি বাহিনীর প্রতাপের পিছনেও দায়ি ছিল এই ওষুধটি। বিশ্বযুদ্ধের বেশ কিছু নথিতেই স্পষ্ট উল্লেখিত রয়েছে, ফ্রান্স অধিগ্রহণের সময় জার্মান সেনারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন একটানা প্রায় তিন দিন। নথি অনুযায়ী, ১৯৪০ সালে ফ্রান্স অধিগ্রহণের সময় প্রায় সাড়ে তিন কোটি ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়েছিল জার্মান সেনাদের।
তবে সমস্ত সেনারাই যে এক ধরনেরই ড্রাগ ব্যবহার করতেন, তেমনটা নয়। ছিল তাদের নিজস্ব পছন্দের বিশেষ ওষুধ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা। কোনো ওষুধ তাদের যন্ত্রণামুক্ত করত, আবার কোনো কোনো ড্রাগ ব্যবহৃত হত গতিবৃদ্ধির জন্য।
ইতিহাসবিদদের মতে, মেথ বা সিন্থেটিক ড্রাগের শুধু আবিষ্কারই নয়, ব্যবহারও শুরু হয়েছিল জার্মানির হাত ধরেই। এই সত্য জানতে আরেকটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। ১৯৩৮ সালে হিটলারের সম্মতিতেই বার্লিনে গড়ে উঠেছিল টেমলার ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা। আর সেই কারখানাতেই শুরু হল মেথের গণউৎপাদন। ‘পারভিটিন’ নামে ট্যাবলেটের আকারে বাজারে এল সেই ড্রাগ।
উদ্দীপক এবং হতাশানাশক ওষুধ হিসাবেই তা পাওয়া যেত জার্মানির সমস্ত কাউন্টারে। অবশ্য তার আগে ৯০ জন ইহুদি শিক্ষার্থীদের ওপরে এই ওষুধের ‘ট্রায়াল’ চালিয়েছিলেন এক নাৎসি মিটিটারি চিকিৎসক।
হিটলার নিজেও অভ্যস্ত ছিলেন এই মাদকসেবনে। শুধু মাদকই নয়, বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশনও নিতেন এবং তা বিশ্বযুদ্ধেরও বহু আগে থেকেই। তিরিশের দশকের একেবারে শুরুর দিকে জার্মান চিকিৎসক ডঃ থিওডোর মোরেলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল হিটলারের। হিটলার তখন ভুগছেন অন্ত্রের সমস্যায়। ব্যাকটেরিয়াজাত একটি ওষুধের মাধ্যমে হিটলারকে সারিয়ে তুলেছিলেন মোরেল। তারপরই তার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে ওঠেন হিটলার।
মিউনিখের ‘ইনস্টিটিউট অফ কন্টেম্পোরারি হিস্ট্রি’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল আর্কাইভ’-এ এখনও সংরক্ষিত রয়েছে মোরেলের লেখা ডায়েরি। সেই নথি থেকেই জানতে পারা যায় হিটলার প্রায় প্রতিদিনই অ্যামফিটামিনস, বারবিট্রেটস, আফিয়েটস, মেথ-সহ একাধিক ড্রাগ নিতেন। যদিও পারভিটিন ব্যবহার করতেন না তিনি।
সে সময় জার্মানিতে ‘হিটলারের ব্যক্তিগত চিকিৎসক’ হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন ডঃ মোরেল। হিটলারের তত্ত্বাবধানেই তিনি গবেষণা শুরু করেছিলেন হরমোন নিয়ন্ত্রক ও কৃত্রিম ভিটামিনের ব্যবহারের ওপর। সে সব ওষুধের ট্রায়াল চলত বন্দি ও ইহুদিদের ওপরে। ট্রায়াল সফল হলে, তা প্রথম প্রয়োগ করা হত হিটলারকেই। সব মিলিয়ে শেষ ৯ বছরে প্রায় ৮০০ রকমের ইঞ্জেকশন নিয়েছিলেন হিটলার।
তবে যুদ্ধে ব্যাপকভাবে এই ড্রাগের ব্যবহার জার্মানিকে বাড়তি শক্তিপ্রদান করলেও, এই ড্রাগই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল হিটলারের। ওহলারের গবেষণা বলছে, ১৯৩০ সালের পর থেকেই হিটলারের মানসিকতার দ্রুত পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে। তার ছাপ স্পষ্ট হিটলারের আত্মজীবনে ‘মেইন ক্যাম্প’-এ। ধারণা করা হয়, ড্রাগের প্রভাবেই নিষ্ঠুর পদক্ষেপ নিয়েছেন হিটলার। যে কারণে, ‘বন্ধু’ স্তালিনও শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছিল তার প্রতিপক্ষ।
এরপর শেষে বার্লিনের বাঙ্কারে নিজের মাথায় গুলি করে সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেছিলেন হিটলার। এর পিছনেও রয়েছে ড্রাগের প্রভাব, এমনটাই অনুমান ওহলারের। বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষে যখন জার্মানির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল মিত্রশক্তি, তখন বন্ধ হয়ে যায় সিন্থেটিক ড্রাগের উৎপাদন। বাঙ্কারে গা ঢাকা দিয়ে থাকা হিটলারের অবস্থা তখন হয়ে উঠেছিল পাগলপ্রায়। শেষ পর্যন্ত কি সেই কারণেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আত্মহত্যার? জানা নেই নিশ্চিত উত্তর। তবে ওহলারের অনুমান যে পুরোটাই ভুল, তাও কিন্তু নিশ্চিত নয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ