পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বনাঞ্চল আমাজন। বনাঞ্চলটি এতো বড় যে, দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে পৃথিবীর নবম বৃহত্তম দেশ হতো আমাজন। যুক্তরাজ্য এবং আয়ারল্যান্ড অনায়াসে ১৭ বার রাখা যাবে এ বনাঞ্চলে। ৯টি দেশ মিলে বিস্তৃত এই বন। এটি একটি এমন ইকোসিস্টেম যা পুরো পৃথিবীর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। এত বড় বনাঞ্চল ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে।
আমাজন বনে গত অক্টোবরে রেকর্ড পরিমাণ বন উজাড় করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ব্রাজিলিয়ান সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে এমনটি বলা হয়েছে। এই তথ্য প্রকাশ করার কয়েক দিন আগেই কোপ২৬ সম্মেলনে পরিবেশ ইস্যুতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যের কথা জানিয়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো।
ব্রাজিলের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চের পক্ষ থেকে বলা হয়, গত অক্টোবরে আমাজনের ৮৭৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকার বন উজাড় করা হয়েছে। এটি ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও শহরের অর্ধেক। ২০২০ সালের অক্টোবরের চেয়ে চলতি বছরের একই সময়ে আমাজনে বন উজাড় পাঁচ শতাংশ বেড়েছে।
অবৈধ খনন এবং কৃষিকাজের জন্য ২০২০ সাল থেকে আমাজনে বন উজাড় বেড়েছে। চলতি বছর এই পরিমাণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। ২০২১ সালে এ পর্যন্ত আমাজনের সাত হাজার ৮৮০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার বন উজাড় করা হয়েছে।
গ্লাসগো সম্মেলনকে ঘিরে ২০৩০ সালের মধ্যে বনভূমি নিধনের ইতি টানতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিল অন্যতম। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির প্রেসিডেন্ট বলসোনারো ২০২৮ সালের মধ্যে অবৈধভাবে বন উজাড় ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কিন্তু পরিবেশবাদি সংগঠনগুলো বলছে, বলসোনারোর আমলেই খনন কাজ আর কৃষি জমি তৈরির জন্য বননিধন বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এই প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে সন্দিহান তারা।
গ্রিনপিস আমাজন ক্যাম্পেইনের মুখপাত্র রোমুলো বাতিস্তা বলেন, বননিধন এবং আগুন লাগার ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং আদিবাসী ও স্থানীয়দের মধ্যে সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। এই প্রতিশ্রুতি আদৌ বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন করবে না।
আইএনপিইর তথ্য-উপাত্ত বলছে, আমাজনে শুধু অক্টোবরেই ১১ হাজার পাঁচশর বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ছিল ১৭ হাজার তিনশ। কিন্তু ২০১৯ সালের পর এসব ঘটনা দ্রুত বেড়েছে এবং তখন ছিল সাত হাজার নয়শটি।
২০১৯ সালে জাইর বলসোনারো ক্ষমতায় বসার পর আমাজনের ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার খোয়া গেছে এক বছরেই, যার আয়তন প্রায় লেবাননের সমান। গত দশকে এটা ছিল ৬ হাজার পাঁচশ বর্গকিলোমিটার।
এদিকে সম্প্রতি কলাম্বিয়ার পরিবেশমন্ত্রী কার্লোস এডওয়ার্ডো কোরেয়া এক বিবৃতিতে জানান, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই দক্ষিণ আমেরিকার কলোম্বিয়ায় আমাজন বনে ৪২ হাজার হেক্টর (এক লাখ পাঁচ হাজার দুই শ’ ৬৭ একর) বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। কলোম্বিয়ায় বনভূমি সংরক্ষণে কঠিন আইন ও বনভূমি ধ্বংসে ১৫ বছরের কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও অব্যাহতভাবে বিপুল বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে।
কলাম্বিয়ার কাকেটা, মেটা ও গাভিয়ারে প্রদেশের ধ্বংস করা এই বনভূমি গত বছরের একই সময় পর্যন্ত ধ্বংস বনভূমির পরিমাণ থেকে ৩৪ ভাগ কম জানায় মন্ত্রণালয়। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত এই তিন প্রদেশে আমাজনের মোট ৬৪ হাজার পাঁচ শ’ হেক্টর (এক লাখ ৫৯ হাজার তিন শ’ ৮৩ একর) বনভূমি ধ্বংস হয়।
দক্ষিণ আমেরিকার ছোট–বড় নয়টি দেশকে ঘিরে রয়েছে আমাজন অরণ্যের বিস্তার। এই দেশগুলো হলো ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল, পেরু, বলিভিয়া, কলাম্বিয়া, ইকুয়েডর, গায়ানা, সুরিনাম আর ফ্রান্স (ফ্রান্স গায়ানা)।
বিশ্বের ১২টি রেইনফরেস্টের মধ্যে আমাজন বেসিনের রেইনফরেস্ট বৃহত্তম। প্রকৃতপক্ষে এর আয়তন ছিল ২ দশমিক ১২৪ মিলিয়ন বর্গমাইল। দক্ষিণ আমেরিকার আয়তন ৬ দশমিক ৮৯০ মিলিয়ন বর্গমাইল।
পাঁচ দশক ধরে মানুষ এই অরণ্যকে সংকুচিত করে চলেছে অপরিণামদর্শিতার সঙ্গে। ৫৫ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর আগেও আমাজন অরণ্যের অস্তিত্ব ছিল বলে ভূতত্ত্ববিদদের অভিমত। এর জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকান প্লেট (আটলান্টিক ওশানে মেজর টেকটোনিক প্লেট, যার মধ্যে পুরো দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ রয়েছে এবং এটি আফ্রিকান প্লেট পর্যন্ত বিস্তৃত) এবং নাজকা প্লেটের সংঘর্ষে যখন আন্দিজ পর্বতমালার সৃষ্টি হয়।
ব্রাজিল থেকে গায়ানা পর্যন্ত এক বিরাট অঞ্চল সেই সংঘর্ষেই জেগে ওঠে। মাঝখানে বয়ে যায় আমাজন নদীসহ অসংখ্য নদনদী। এখানে প্রথম প্রাণের লীলা চাঞ্চল্য জেগে ওঠে সবুজ ঘাসের আস্তরণে। তারপর বৃক্ষরাজি, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি আর মানুষের আশ্রয়দাতা হয়ে ওঠে আমাজন রেইনফরেস্ট।
জীবের জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন যতটা জরুরি, পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীর সব রেইনফরেস্ট। রেইনফরেস্ট পৃথিবীর ফুসফুস। এরা কেবল জল, বায়ু, খাদ্য আর ওষুধ উৎপাদনের উৎস নয়; হাজারো প্রাণিপ্রজাতির আশ্রয়দাতা। বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস শুষে নেওয়ার শক্তিশালী শোষক।
একুশ শতকের পরিবর্তিত জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব রুখে দিতে সে কারণেই কিংবদন্তি ভূমিকা রয়েছে রেইনফরেস্টগুলোর। এ জন্যই আমাজন অরণ্যের ধ্বংস নিয়ে সারা পৃথিবী উদ্বিগ্ন আজ।
ব্রাজিলের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চের পক্ষ থেকে বলা হয়, গত অক্টোবরে আমাজনের ৮৭৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকার বন উজাড় করা হয়েছে। এটি ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও শহরের অর্ধেক। ২০২০ সালের অক্টোবরের চেয়ে চলতি বছরের একই সময়ে আমাজনে বন উজাড় পাঁচ শতাংশ বেড়েছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য রয়েছে আমাজনের জঙ্গলে। সত্তর দশকের কিছু আগেও এর আয়তন ছিল ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার (২১ লাখ ২৩ হাজার ৫৬২ বর্গমাইল)। সত্তর দশকে আয়তন পরিমাপ করা হয় ৪১ লাখ বর্গকিলোমিটার। নব্বইয়ের মধ্যভাগে মহা অরণ্যের বিরাট শরীর আরও বেশি সংকুচিত হয়ে পড়ে।
অরণ্য সুরক্ষায় তখনকার ব্রাজিলিয়ান সরকার ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব মিলে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু এই অসাধারণ ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্টের করুণ পরিণতি তাতে ঠেকানো যায়নি। অবৈধ ও বৈধ—দুভাবেই ক্রমাগত বিস্তীর্ণ বনভূমি উজাড় হতে থাকে।
২০১৬ সালের নতুন পরিমাপে ধরা পড়ে ক্ষীণাঙ্গ হতে হতে আমাজনের আয়তন দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৮৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। ২০১৮ সালে ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জাইর বলসোনারো। তিনি এ দেশের ৩৮তম প্রেসিডেন্ট। বিভিন্ন তথ্যসূত্রের প্রকাশ, তার উৎসাহে তীব্রভাবে চলতে থাকে নতুন শিল্পকারখানা আর নতুন কৃষিজমি আবিষ্কারের পরিকল্পনা। আমাজনে ঘটতে থাকে একের পরে এক অগ্নিকাণ্ডের সব ভয়াবহ ঘটনা।
অবশ্য আমাজন বেসিনের রেইনফরেস্ট ২০১৯ সালেই যে প্রথম লেলিহান শিখায় জ্বলছে তা নয়; এখানকার প্রাচীন ইতিহাস বলছে, বাসস্থান গড়তে, কৃষিজমির প্রস্তুতিতে এই অঞ্চলের মানুষ বহুবার পুড়িয়েছে এই অরণ্যকে। এ ছাড়া, শুষ্ক মৌসুমে দাবানলের ঘটনাও রেইনফরেস্টগুলোর এক স্বাভাবিক ঘটনা।
কিন্তু বিশ শতক থেকে যেভাবে সারা বিশ্বে অরণ্যভূমি বিনষ্ট করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, অতীতে সেভাবে কোনো দিনও হয়নি। বরং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা বজায় রেখে হাজার হাজার বছর ধরে অরণ্যবাসী মানুষ ও বন্য প্রাণী বসবাস করে এসেছে অরণ্যের অভ্যন্তরে। এরপর জনসংখ্যা যত বেড়েছে, জড়বিজ্ঞানের প্রবল প্রতাপ যত বেশি আকাশচুম্বী হয়েছে, ততই অরণ্য সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।
১৯৭০ সালে আমাজনের বনভূমি প্রথম ধাপে উজাড় হওয়া শুরু হয় যখন ব্রাজিলের সামরিক সরকার খেয়াল করে এই বনের ভেতর লুকিয়ে আছে বিশাল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এ বন থেকে ব্রাজিলের তৎকালীন সরকার অর্থনৈতিক উন্নতির অপার সম্ভাবনা দেখছিল। কিন্তু দুর্গম বনভূমির জন্য এগুলো সংগ্রহ করা অসম্ভব ছিল। তাই ব্রাজিলের সরকার আমাজনের ভেতর দিয়ে ৩,২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ট্রান্স-আমাজনিয়ান হাইওয়ে নির্মাণ করা শুরু করে যা আমাজনের গহীন অরণ্যে মানুষের প্রতিনিয়ত চলাচলের সূচনা করে।
ওই সময়ে ব্রাজিলের বেশিরভাগ মানুষ দক্ষিণ-পূর্বে রিও-ডি-জেনিরো, সাও পাওলোর মত শহরে থাকতো। ব্রাজিলের সরকার জমি চাষাবাদ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে জনগণকে আমাজনে স্থানান্তর করতে চেয়েছিল। এই লক্ষ্যে ব্রাজিলের সরকার এই হাইওয়ের পাশে বিনামূল্যে জমির বিতরণ করা শুরু করেছিল, এরই সাথে সাথে জনগণকে প্রণোদনা দেওয়াও শুরু হয়েছিল এখানে বসতি স্থাপনের জন্য। হাইওয়ে নির্মাণের সাথে সাথে তার চারপাশের বন উজাড়ের হারও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এসকল বেশিরভাগ জমিই গরুর খামার করার জন্য চারণভূমিতে রুপান্তরিত করা হয়। লাভবান ব্যবসা হওয়ায় চারণভূমি বাড়ানোর জন্য আমাজনের আরো গহীনে বনভূমি উজাড় করা শুরু হয়।
জড়বিজ্ঞান সভ্যতায় বছরের পর বছর ধরে সীমাহীন নগরায়ণের কারণে, শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজে, আসবাবপত্র কিংবা জ্বালানির ব্যবহারে, কৃষিজমির অনুসন্ধানে এবং আরও হাজার রকমের নিষ্ঠুর অভিপ্রায় নিয়ে বিশাল বিস্তীর্ণ বনভূমিকে মানুষ নিঃশেষিত করেছে অপূরণীয় ক্ষতিতে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, যত বেশি বনাঞ্চল ধ্বংস হবে, তত বেশি মারণ ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ, বনভূমি হল মানুষ ও ভাইরাসের মাঝে ঢাল। এমনটা আগেই জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। বন্য প্রাণীর শরীরে থাকা অজানা ভাইরাস ছড়ানো রোধ করতে হলে বনাঞ্চল ধ্বংস আটকাতে হবে সবার আগে।
তারা বলছেন, করোনার পরবর্তী ভাইরাস ছড়াতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্য আমাজন থেকে। কারণ সেখানে নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। আর সেটা সব থেকে চিন্তার বিষয় এখন।
সারা বিশ্বের ২০ শতাংশ অক্সিজেনের জোগান দেয় আমাজন বনভূমি। তার থেকেও বড় কথা, এই বনভূমিতে বহু নাম না জানা প্রাণীও রয়েছে। তাদের শরীরে রয়েছে অজানা প্রাণঘাতী ভাইরাস। সেই ভাইরাস একবার মানুষের মধ্যে ছড়াতে শুরু করলে বিপদ।
ব্রাজিলের পরিবেশ বিজ্ঞানী ডেভিড লাপোলা জানিয়েছেন, বনাঞ্চলে নগরায়ন করলে বিভিন্ন প্রাণী থেকে ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়ানো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমাজনের গভীর অরণ্যে বহু চেনা-অচেনা ভাইরাস রয়েছে। মানুষ বনাঞ্চল ধ্বংস করে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলে সেই ভাইরাসে সংক্রমিত হবে। আর আমাজন যেভাবে ধংস করা হচ্ছে তাতে এর পর সেখান থেকেই নতুন কোনও ভাইরাস ছড়াতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ