সংবিধান, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও দেশে থেমে নেই হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু। এরই ধারাবাহিকতায় নরসিংদীতে পুলিশ হেফাজতে সুজন সাহা নামে এক যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। হ্যান্ডকাপ পরা অবস্থায় হাড়িদোয়া নদী থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মঙ্গলবার সকালে শহরের হাজিপুরে এ ঘটনা ঘটে।
তবে স্বজনদের অভিযোগ, হাতকড়াসহ তাকে বাবুল সাহা চানাচুর ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা ও পুলিশ মারধর করে মৃত্যু অবস্থায় হাঁড়িদোয়া নদীতে ফেলে দিয়েছে। পরে নদী থেকে জাল দিয়ে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মৃত ওই যুবকের নাম সুজন সাহা (২৭)। তিনি হাজিপুর এলাকার অজিত সাহার ছেলে। তিনি শেকেরচরে একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করতেন।
নিহতের বাবা আজিত সাহা গণমাধ্যমকে বলেন, সোমবার রাতে পুলিশ সুজনকে খুঁজতে তার বাসায় যায়। তখন গেট খুলতে না চাইলে পুলিশ গেটের তালা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে তল্লাশি চালায়। পরে তাকে ফোন দিয়ে পুলিশের সঙ্গে দেখা করতে বলে। পরে সকালে ব্রাহ্মন্দী থেকে তাকে ধরে হাজীপুর বাবুলের চানাচুর ফ্যাক্ট্ররিতে নিয়ে আসে পুলিশ। সেখানে এলোপাথাড়ি পিটিয়ে হত্যার পর তাকে নদীতে ফেলে দেয়। পরে হাজিপুরের হাড়িদোয়া নদীতে জাল ফেলে তাকে উদ্ধার করা হয়।
তবে পুলিশ বলছে, সুজনকে গ্রেপ্তারের পর থানায় নেওয়ার সময় সে হ্যান্ডকাপ পরা অবস্থায় পুলিশের ওপর হামলা করে পালিয়ে যেতে নদীতে ঝাঁপ দেয়।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সুজনের বিরুদ্ধে একাধিক ওয়ারেন্ট রয়েছে। সেই ওয়ারেন্ট তামিল করতে তাকে হাজিপুরের চানাচুর ফ্যাক্টরি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেখান থেকে সুজনকে থানায় নেওয়ার পথে তিনি অতর্কিত পুলিশের ওপর হামলা চালান। ওই সময় তার কাছে থাকা ছুরি দিয়ে দুই পুলিশ সদস্যকে উপর্যপুরি ছুরিকাঘাত করেন। এতে দুই পুলিশ সদস্য আহত হন।
নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সাহেব আলী পাঠান বলেন, সুজন একজন পেশাদার অপরাধী। তার বিরুদ্ধে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মারামারিসহ ১০টি মামলা রয়েছে।
পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, থানায় নেওয়ার সময় সুজন পালাতে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন। তখন তিনি নদীতে তলিয়ে যান। সেখানে কোনো কিছুতে আটকে গিয়ে তার মৃত্যু হয়।
তাছাড়া পুলিশের হাত থেকে পালাতে গিয়ে সুজন পুলিশের ওপর হামলা করেন। তখন সদর মডেল থানার এসআই মোজাম্মেল ও কনসস্টেবল মাইনুলকে উপর্যপুরি ছুরিকাঘাত করেন। এতে দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা ক্রমশ বেড়েই চলছে। আর এসবের সবকটাই ক্ষমতার অপব্যবহারকে কেন্দ্র করেই হয়ে থাকে বলে মনে করেন তারা।
তারা বলেন, পুলিশে ঢোকার পর স্বাভাবিক একজনের ভেতরেও আশ্চর্য এক পরিবর্তন আসে। স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার চূড়ান্ত ভেবে তারা যা ইচ্ছা তা করার মানসিকতা নিয়ে দাপটের সাথে চলতে থাকেন। ফলে ঘর থেকে বাহির কেউ তাদের কুৎসিত হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আইনের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাশীল না হলে পুলিশের বিরুদ্ধে এমন আরও অসংখ্য অভিযোগ আসতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে হত্যাকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের মানসিকতাই যে সহযোগী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই কাজে পরোক্ষ ভূমিকা পালনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও যে পিছিয়ে নেই, তা এই প্রতিষ্ঠানের নির্লিপ্ততাতেই স্পষ্ট। কমিশন একবার বলেছিল যে বেছে বেছে কয়েকটা ঘটনার তদন্ত করবে, সেই কথা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কমিশনের জবাবদিহির অভাব পুলিশ এবং সরকারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
আরও বলেন, পুলিশের কর্মকর্তারা একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছেন, যেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল করে দেওয়া হয়। এই দাবি একেবারে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে এমন নয়। তদুপরি, পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতে এই বাহিনীর সদস্যরা যে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বেই ভাববেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই; হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা সেগুলো প্রতিদিন প্রমাণ করে দিচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৭
আপনার মতামত জানানঃ