বিতর্কিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম রিংআইডি পঞ্জি স্কিমের মাধ্যমে মানুষকে অনলাইনে আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে চলতি বছরের মাত্র তিন মাসে (এপ্রিল, মে ও জুন) ৩০২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে প্ল্যাটফর্মটির জালিয়াতিমূলক কর্মকাণ্ড উঠে আসার পর ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে মেম্বারশিপ বিক্রি ও আর্থিক লেনলেন বন্ধ করে দেয় রিংআইডি। তবে তার আগে কেবল জুন মাসেই ১০২ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে প্ল্যাটফর্মটি।
গ্রাহকদের তারা অনলাইনে আয়ের আশ্বাস দিলেও বাস্তবে তাদের ব্যবসা-মডেল ছিল মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ধরনের জালিয়াতি। প্ল্যাটফর্মটির বেশ কিছু ব্যাংক স্টেটমেন্টে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গত এক মাস ধরে রিংআইডির কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করছে বেশ কিছু আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। সংস্থাগুলো টিবিএসকে জানিয়েছে, আত্মসাৎ করা টাকা প্রকৃত অঙ্ক অনেক বেশি হতে পারে। এখন অন্যান্য মাসের ব্যাংক টেস্টমেন্টও নিরীক্ষা করা হচ্ছে।
মামলা দায়ের
এদিকে, প্রতারণার শিকার হওয়া এক ভুক্তভোগী রিংআইডির মালিক শরিফুল ইসলাম, তার স্ত্রী আইরিন ইসলাম ও ভাই সাইফুল ইসলামসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) মামলার বাদী আঁখি বেগম দশজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১৫ জনকে আসামি করে রাজধানীর ভাটারা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং কন্ট্রোল অ্যাক্টের আওতায় মামলা করেন।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের আওতাধীন ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজেদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, ইতিমধ্যে তারা বাদীর তরফ থেকে মামলার অভিযোগপত্র পেয়ে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন।
মামলার এজাহার (এফআইআর) অনুযায়ী, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এর তদন্ত করবে। আরেকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, সিআইডি ইতিমধ্যে মামলার দুই নম্বর আসামি সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন—সালাহউদ্দিন, আহসান হাবীব, রফিকুল ইসলাম, নাজমুল হাসান, আব্দুস সামাদ, রেদওয়ান রহমান, রাহুল। তারা সবাই প্ল্যাটফর্মটির কর্মকর্তা ও এজেন্ট।
মামলার বিবৃতি অনুসারে, রিংআইডির ব্যানারে একটি সংঘবদ্ধ ডিজিটাল জালিয়াতি চক্র ই-লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করত এবং অননুমোদিত এমএলএম ব্যবসার মাধ্যমে স্বর্ণের মুদ্রা বিক্রি করত।
আঁখি বেগম, তার দুই ভাই ও এক ভাগ্নে ২০১৯ সালে রিংআইডিতে কয়েক ধাপে ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। তার এক প্রবাসী ভাই, এসআই টুটুল দেশ ও দেশের বাইরে থেকে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। অথচ তিনি মাত্র একবার খুব সামান্য পরিমাণ টাকা তুলতে পেরেছিলেন। কিন্তু তারা পরে রিংআইডি থেকে কোনো সুবিধা বা রিফান্ড পাননি।
এর আগে গত ২৮ সেপ্টেম্বর সিআইডি রিংআইডির ব্যাংক বিবরণ চাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) রিংআইডির ব্যাংক বিবরণ চেয়েছিল। রিংআইডি ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড ও রিংআইডি বিডি লিমিটেডের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে কি না, সে তথ্যও ব্যাংকগুলোকে দিতে বলেছিল বিএফআইইউ।
রিংআইডির বিরুদ্ধে মেম্বারদের অভিযোগ
একটি সূত্র জানিয়েছে, লোকে ইভ্যালি বা ইঅরেঞ্জ সম্পর্কে জানে যে, এই ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। কিন্তু ভিডিও স্ট্রিমিং বা বিজ্ঞাপনের নামে রিংআইডি এসব ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর চেয়ে বেশি টাকা হাতিয়েছে। স্ক্যামটা সত্যিই অনেক বড়।
ওই সূত্র আরও জানায়, রিংআইডি কর্তৃপক্ষ ২৩ জুলাই থেকে কয়েন কেনার অফার বন্ধ করে দেবে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ পাগলের মতো এতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। অফারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই লোকে সব কয়েন কিনে নিয়ে ফাঁদে পড়ে গেছে।
সম্প্রতি রিংআইডির প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর সার্ভার মেইনটেনেন্স নোটিশ দেখিয়ে সদস্যদের নগদ অর্থ প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
যেসব সদস্যের অ্যাকাউন্টে নিট ব্যালেন্স আছে তারা গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে সংশ্লিষ্ট কোনো এজেন্টের কাছ থেকে ক্যাশ আউট করতে পারেননি। রিংআইডি সদস্য ভোলার বাসিন্দা মো. বাহা উদ্দিন পাবেল ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেছেন যে, বারবার চেষ্টা করেও তিনি গত ১৭ দিন ধরে তার টাকা তুলতে পারছেন না।
টাঙ্গাইলের মো. শুভ আহমেদ তার হতাশার কথা জানিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, তিনি তার আইডি ব্যালেন্স এজেন্টের কাছে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু গত দুই সপ্তাহে ধরে তাকে টাকা দেওয়া হচ্ছে না।
তিনি বললেন, ‘সঞ্চয়ের সব টাকা নিয়ে আমি মেম্বারশিপ কেনায় বিনিয়োগ করেছিলাম। তাই এখন আমার হাতে কোনো টাকা নেই। এমনকি আমি এখন নিজের মোবাইল খরচও চালাতে পারছি না।’
মরিয়া হয়ে মেম্বারশিপ বিক্রি করার চেষ্টা করছেন ব্যবহারকারীরা। অনেক রিংআইডি ব্যবহারকারীই এখন মরিয়া হয়ে নিজের সদস্যপদ অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে মূলধন ফিরে পেয়েছেন, অন্যরা এখনও এক পয়সাও পাননি।
যশোরের তাহমিদ আহমেদ একটি রিংআইডি গ্রুপে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছেন যে, তিনি তার গোল্ড মেম্বারশিপ বিক্রি করতে চান। সদস্যপদটি তিনি এক মাস আগে কিনেছিলেন। শুভ সদস্যপদটি কিনেছিলেন ২২ হাজার টাকায়। এখন এতে ৪ হাজার টাকা ব্যালেন্স আছে। তবে তিনি সদস্যপদটি মাত্র ২২ হাজার টাকায় বিক্রির প্রস্তাব দেন।
ঝিনাইদহ জেলার রিংআইডি ব্যবহারকারী আশরাফুল ইসলাম ইমরানও রিংআইডি কমিউনিটি জবস ফেসবুক গ্রুপে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেন যে, তিনি তার সিলভার ও গোল্ড মেম্বারশিপ বিক্রি করতে চান। দুই সদস্যপদে তার যথাক্রমে ৭৫০ টাকা ও ২ হাজার টাকা ব্যালেন্স আছে।
যেভাবে অর্থ আত্মসাৎ করেছে রিংআইডি
রিংআইডি এমএলএম মডেল অনুসরণ করে ব্যবসা করলেও নিজেদের এরা ‘কমিউনিটি ব্যবসা’ বলে দাবি করে। প্ল্যাটফর্মটিতে নতুন সদস্য আনতে পারলে পুরনো সদস্যদের ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা দেওয়ার অফার দেওয়া হয়। এভাবেই প্ল্যাটফর্মটি সদস্য বাড়ায়।
বিজ্ঞাপন দেখা ও শেয়ার করা, নতুন সদস্য আনা, প্ল্যাটফর্মটির পণ্য বিক্রি ও রিংআইডি মুদ্রা লেনদেনের জন্য শিক্ষার্থীদের টাকা দেয় প্ল্যাটফর্মটি। মোটা আয়ের অফারে আকৃষ্ট হয়ে পুরনো সদস্যরা তাদের পরিবারের সদস্য, বন্ধু এবং পরিচিতদের রিংআইডি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসেন।
কমিউনিটি জবের ব্যান্ড প্রমোটারের অধীনে রিংআইডি দুই ধরনের সদস্যপদ দেয়— সিলভার ও গোল্ড। সিলভার ক্যাটাগরির মেম্বারশিপের জন্য রিংআইডি ১২ হাজার টাকা চার্জ নেয়। এই ক্যাটাগরিতে প্রতিদিন ৫০টি বিজ্ঞাপন দেখে ২৫০ টাকা আয়ের সুযোগ রয়েছে। গোল্ড ক্যাটাগরির সদস্যপদ কেনার জন্য খরচ করতে হয় ২২ হাজার টাকা। এই ক্যাটাগরির সদস্যরা দিনে ১০০টি বিজ্ঞাপন দেখে ৫০০ টাকা আয়ের সুযোগ পান।
অর্থ লেনদেন হয় বিকাশ, নগদ, রকেট, শিউরক্যাশের মতো মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) মাধ্যমে। এ ব্যবসায় একটা মোবাইল নম্বর থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা রিংআইডির নিজস্ব এজেন্টদের মাধ্যমেও লেনদেন হয়।
সূত্র জানিয়েছে, প্ল্যাটফর্মটিতে এখন ৬০০-র বেশি এজেন্ট রয়েছে। এজেন্ট রয়েছে তিন ক্যাটাগরির—সিলভার, গোল্ড ও ডায়মন্ড। অর্থের বিনিময়ে এসব এজেন্ট নেয় প্রতিষ্ঠানটি। সিলভার, গোল্ড ও ডায়মন্ড ক্যাটাগরির এজেন্ট হওয়ার জন্য যথাক্রমে ১ লাখ, ২ লাখ ও ৫ লাখ টাকা নেয় রিংআইডি।
এছাড়াও রিংআইডি অ্যাপে কোম্পানিটির ডিজিটাল মুদ্রা লেনদেন ব্যবসাও রয়েছে। প্রতি কয়েনের মূল্য ৮৬ টাকা। সদস্যরা এসব কয়েনকে টাকায় রূপান্তরিত করতে পারেন এবং মোবাইল আর্থিক পরিষেবার মাধ্যমে এসব টাকা ওঠাতে পারেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১০৫৬
আপনার মতামত জানানঃ