বাংলাদেশের ৯৬ শতাংশ নারী কখনও কম্পিউটার ব্যবহার করেননি। শহুরে নারীরা এ ক্ষেত্রে সামান্য এগিয়ে থাকলেও অবস্থা তেমন ভালো নয়। তাদের কেবল ১৩ শতাংশ কম্পিউটার ব্যবহার করেছেন। জরিপে অংশ নেওয়া এই নারীরা বয়সে তরুণ।
গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া যায়। সানেম ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যৌথ আয়োজনে গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। মূল বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশের জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেটবিষয়ক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন’।
নারীদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের হারও অত্যন্ত কম। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ৮৫ শতাংশ নারী কখনো ইন্টারনেট ব্যবহার করেননি। কেবল গ্রামীণ নারীদের কথা বলা হলে পরিমাণটা ৮৭ শতাংশ। আর শহুরে নারীদের বেলায় সেটা ৭৭ শতাংশ। এ ক্ষেত্রেও কেবল তরুণ নারীদের কথা বলা হয়েছে।
অথচ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবে, গত জুলাইয়ের শেষে দেশে নারী-পুরুষ মিলিয়ে মোট মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৩৬ লাখ ৯০ হাজার। একই হিসাবে দেশের ব্রডব্যান্ডের গ্রাহকসংখ্যা ১ কোটির কিছু বেশি।
সানেমের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শহরের ৪৩ শতাংশ এবং গ্রামের ৫৮ শতাংশ নারীর নিজস্ব মুঠোফোন নেই। পুরুষেরা বেশ এগিয়ে। মুঠোফোন নেই—এমন পুরুষের পরিমাণ শহরে ১৮ শতাংশ, আর গ্রামে ২২ শতাংশ।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রেসিডেন্ট ফওজিয়া মোসলেমের সভাপতিত্বে ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন সানেমের জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী ইশরাত শারমিন। স্বাগত বক্তব্য দেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।
প্রতিবেদন তৈরির গবেষক দলে ছিলেন সায়মা হক বিদিশা, ইশরাত শারমিন, ওমর রাদ চৌধুরী, সৈয়দা তাসফিয়া তাসনিম, শাফা তাসনিম, হালিমা বিনতে ইসলাম ও নাইম রহমান খান।
এদিকে, ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে মাত্র ছয় শতাংশ পরিবারের কম্পিউটার আছে; আর মাত্র চার শতাংশের কম নারী কম্পিউটার ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্যও বিদ্যমান।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে, অন্য বিভাগের চেয়ে কম্পিউটার মালিকানা অনেক বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ প্রাপ্তিতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।
শহর অঞ্চলে মাত্র ৫০ শতাংশ পরিবারের ইন্টারনেট সুবিধা আছে। গ্রামাঞ্চলে এ সুবিধা আছে মাত্র ৩০ শতাংশ পরিবারের।
সারা দেশে মাত্র ১০ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। অন্যদিকে মোবাইল ইন্টারনেট সেবার দ্রুততার ক্ষেত্রে র্যাংকিংয়ে ১৪৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৪। ফলে, শুধু ইন্টারনেট সেবা প্রাপ্তিই নয়, সেবার মানও প্রশ্নসাপেক্ষ।
“জেন্ডারঅ্যান্ড ইয়ুথ ইনক্লুসিভনেস ইন টেকনোলজি ইন বাংলাদেশ” শীর্ষক একটি ওয়েবিনারে উপস্থাপতি প্রবন্ধে এসব কথা বলেন, সানেমের রিসার্চ ইকোনমিস্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক মাহতাব উদ্দিন।
তিনি বলেন, আইসিটি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের হার অত্যন্ত কম। এক্ষেত্রে জেন্ডার ভেদও লক্ষ্যণীয়: মাত্র ৩শতাংশ নারী ও ৪ শতাংশ পুরুষ। দেশের জনসংখ্যার তুলনায়
কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষার অবকাঠামো অপ্রতুল। এ ধরনের শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের চাহিদাও কম। ২০১৯-২০ এ ৬২৪টি সরকারি ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিপ্লোমা কোর্সে প্রায় ১,৩৫,০০০ আসন ফাঁকা পড়েছিল। ৫১১টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ১৮৫,০৫৫টি আসনের মধ্যে ১২৭,৯৭৬টি আসন ফাঁকা ছিল। ৪৯টি সরকারি ইনস্টিটিউট এবং ৬৪টি টেকনিকাল স্কুল এবং কলেজে ৭,১২৭টি আসন ফাঁকা ছিল। তবে, সব কয়টি প্রতিষ্ঠানেই প্রশিক্ষক এবং শিক্ষা প্রণালীর মান প্রশ্ন সাপেক্ষ।
ন্যাশনাল স্কিলস ডেভেলপমেন্ট পলিসি (২০১১) এবং ন্যাশনাল ট্রেইনিং এন্ড ভোকেশনাল কোয়ালিফিকেশন্স নেটওয়ার্ক—এই দু’টি নীতি প্রণয়নের পরেও, কারিগরি শিক্ষার মান সংক্রান্ত বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৪, যা দুর্বলতাই নির্দেশ করে।
“ব্লাইণ্ডার-অক্সাকা ডিকমপোজিশন” প্রক্রিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে গবেষণাটিতে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেখা গেছে, ভৌগলিক অবস্থান (গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত পরিবার বা রাজশাহী, রংপুর এবং সিলেট অঞ্চলের পরিবার), পরিবারে নারী সদস্যদের আনুপাতিক হার, পরিবার প্রধানের লিঙ্গ, ইত্যাদি জেন্ডার বৈষম্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রবাসী, পরিবারে আয়, পরিবারের স্কুলে যাওয়ার গড় সময় এবং ভৌগলিক অবস্থান, এই বৈষম্যে হ্রাসে ভূমিকা রাখে।
মাহতাব উদ্দিন গবেষণার ভিত্তিতে কিছু প্রস্তাবও তুলে ধরেন। তিনি জেন্ডার অন্তর্ভুক্তিমূলক আইসিটি নীতি, জেন্ডার অন্তর্ভুক্তিমূলক আইসিটি কর্ম পরিকল্পনা এবং আইসিটি বান্ধব আর্থিক নীতি প্রণয়নের প্রস্তাব করেন। টেলিকমিউনিকেশন খাতের জন্য কর ছাড়ের কথাও বিবেচনা করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
নারীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর জোর দেন তিনি। কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন কেনার ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ভ্যাট ছাড় দেয়া যেতে পারেও বলে প্রস্তাব রাখেন তিনি। গবেষণায়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর (আইসিটি মন্ত্রণালয়, যুব মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়) সমন্বয়ে “প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্তিকরণ” বা “টেকনোলজি ইনক্লুসিভনেস” এর ওপর বিশেষায়িত যৌথ টাস্ক ফোর্স গঠনের প্রস্তাবও তুলে ধরা হয়।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার সঠিকভাবেই ডিজিটাল বাংলাদেশ এর নীতি গ্রহণ করেছে, তবে, জেন্ডার, বয়স, অঞ্চল এবং আয় ক্ষমতা ভেদে প্রযুক্তির সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে এখনো বৈষম্য বিরাজ করছে। ফলে, এই গবেষণা বাংলাদেশে প্রযুক্তি ব্যবহারে তরুণ ও জেন্ডার অন্তর্ভুক্তির নিয়ে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে বলে জানান মাহতাব উদ্দিন । বাংলাদেশে বেশ বড় ধরণের ডিজিটাল বৈষম্য বা বিভাজন বিরাজ করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ডিজিটাল বৈষম্যের ধারণাটিও তুলে ধরেন তিনি—তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ কাদের আছে আর কাদের নেই, সেই পার্থক্য এই ধারণার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, তরুণদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ছেলের মোবাইল ফোন থাকলেও, মেয়েদের মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ মোবাইল ফোন রয়েছে। গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়, সবচেয়ে বেশি আয় করে যে দশ শতাংশ পরিবার, সেখানে ৯২ শতাংশ তরুণের মোবাইল ফোন রয়েছে, অন্যদিকে সবচেয়ে কম আয় করে যে দশ শতাংশ, সেখানে মাত্র ৭২শতাংশ তরুণের মোবাইল ফোন আছে। সবচেয়ে বেশি আয় করা ১০শতাংশ পরিবারের ৭৩শতাংশ তরুণীর হাতে মোবাইল ফোন থাকলেও, সবচেয়ে কম আয় করা ১০শতাংশ পরিবারের মাত্র ২৪শতাংশ তরুণী মোবাইল ফোনের মালিক। ফলে স্পষ্টতই, নিম্নতম আয়ের দশমাংশে এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে মোবাইলের মালিকানার পার্থক্য ৪৪ আর উচ্চতম আয়ের দশমাংশে এ পার্থক্য ১৯।
এ গবেষণায়, “ইন্ট্রা-হাউজহোল্ড জেন্ডার প্যারিটি ইনডেক্স” তৈরি করা হয়েছে, যেটির মাধ্যমে নারীর প্রতি বৈষম্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে, বলেন মাহতাব উদ্দিন। এই ইনডেক্সে জাতীয়ভাবে স্কোর পাওয়া গেছে ০.৪৬, যা প্রকট জেন্ডার বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়।
তিনি আরও ব্যখ্যা করেন যে, দরিদ্র্য এবং দরিদ্র্য নয় উভয় ক্ষেত্রেই মোবাইল মালিকানার হার নারীর চেয়ে পুরুষের বেশি। দরিদ্র্য পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে সব বয়সেই নারীর মোবাইল মালিকানা প্রায় একই রকম (৩৪ শতাংশ-৩৭ শতাংশ)। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক অবস্থা যাই হোক না কেন, গড়ে পুরুষদের থেকে নারীদের মোবাইল ফোন অনেক কম।
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির সভাপতিত্ব প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, এমপি। সানেম গবেষণা পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশার সঞ্চালনয় বিশেষজ্ঞ আলোচক ছিলেন এটুআই প্রোগ্রামের নীতি বিষয়ক উপদেষ্টা অনির চৌধুরী, কারিগরি এবং মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ যুগ্ম সচিব আয়াতুল ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব মোহাম্মদ সায়েদ আলী, বেসিস জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফারহানা রহমান। বিশেষ বক্তব্য দেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান।
এসডব্লিউ/ডব্লিউজেএ/২৩২৫
আপনার মতামত জানানঃ