বর্তমান বিশ্বে ব্যাপকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে প্রতি বছর ত্বরিত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে গড় তাপমাত্রার পরিমাণ। সাম্প্রতিক সময়ে অতিমাত্রা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন বিশ্বকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাবের কবলে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। চলতি বছর দেশটির প্রতি তিনজন নাগরিকের একজন জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়েছেন। এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে দেশটির নাগরিকরা আরও নজিরবিহীন দুর্যোগের মুখোমুখি হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ওয়াশিংটন পোস্ট–এর এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত তিন মাসে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এসবের শিকার হয়েছে প্রতি তিনজন আমেরিকানের একজন। বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, গত জুন থেকে এখন পর্যন্ত চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার কবলে পড়ে দেশটিতে মারা গেছে অন্তত ৩৮৮ জন।
ক্যাল ফায়ারের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এখন পর্যন্ত শুধু ক্যালিফোর্নিয়াতেই ৭ হাজারের বেশি দাবানলে পুড়েছে প্রায় ২০ লাখ একরের বেশি বনভূমি। এ বছর অঙ্গরাজ্যটিতে সৃষ্ট দাবানলের সংখ্যা গত বছরের একই সময়ে দেখা দেওয়া দাবানলের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। রাজ্যে নতুন করে শুরু হয়েছে আরেকটি দাবানল। এখন এটি নিয়ন্ত্রণে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন অগ্নিনির্বাপণকর্মীরা। দাবানল থেকে বাঁচতে ইতিমধ্যে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে লাখো মানুষ। এ রাজ্যের দাবানলের ওপর নজর রাখা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘দাবানল নিয়ন্ত্রণে বছরের বাকি সময়টুকু লেগে যেতে পারে’।
এই দাবদাহের উল্টো দিকে, গত সপ্তাহে আঘাত হেনেছে হারিকেন আইডা। এর প্রভাবে নিউ অরলিন্সের কাছে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। লুইজিয়ানায় বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয় অন্তত ১০ লাখ মানুষ। ভারী বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় পাঁচটি অঙ্গরাজ্যে মারা গেছে কমপক্ষে ৫১ জন। বিধ্বস্ত হয়েছে বা ভেসে গেছে অনেক স্থাপনা।
গত মাসের এ বন্যায় টেনেসিতেই মারা গেছে অন্তত ২২ জন। একই সময়ে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড় হেনরির আঘাতে উত্তর–পূর্ব উপকূলজুড়ে ভারী বৃষ্টি, বন্যা ও নানা ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর আগের মাসে আঘাত হানে আরেক গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড় এলসা। কর্মীরা দক্ষিণ ফ্লোরিডার একটি আংশিক বিধ্বস্ত ভবনে অনুসন্ধান পরিচালনা ও সেখান থেকে লোকজনকে উদ্ধারের অভিযান এই ঝড়ের কারণে বন্ধ করতে বাধ্য হন।
ওয়াশিংটন পোস্টের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬৪ শতাংশ আমেরিকান এমন এলাকাগুলোতে বসবাস করে, যেখানে চলতি বছর কয়েক দফা দাবদাহ বয়ে গেছে। দাবদাহকে আবহাওয়ার বিপর্যয় হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা না হলেও একে খুব বিপজ্জনক আবহাওয়ার একটি ধরন হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
গত জুনে প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে শত শত মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরগুলোজুড়ে ওই সময় তাপমাত্রা রেকর্ড ১১৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি ও ফ্লোরিডার ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনের সাবেক প্রধান ক্রেইগ ফিউগেট ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ‘একই গ্রীষ্মে আবহাওয়ার এত বিপর্যয়কর ঘটনা তিনি এর আগে আর দেখেননি।
ফিউগেট বলেন, ‘আমাদের নজিরবিহীন ঘটনা মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যথাযথ প্রস্তুতি। এসবের মধ্যে থাকতে হবে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা, ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট বন্যার পানি ব্যবস্থাপনা ও আবহাওয়াজনিত সংকটকালে আশ্রয়ের ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি।’
সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে বৈঠকে সম্প্রতি আইপিসিসি এর রিপোর্টটি পেশ করেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিয়ো গুতেরেস। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘২০০৮ সালে বিজ্ঞানীরা যা আঁচ করেছিলেন, তার চেয়ে এক দশক আগেই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে’।
২০৩০ সালের মধ্যে গোটা বিশ্বের সার্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে ১৯০১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সমুদ্রের জলস্তর যেখানে প্রতি বছর ১.৩ মিলিমিটার করে বাড়ছিল, ২০০৭ থেকে ২০১৮ সালে তা বছরে ৩.৭ মিলিমিটারে গিয়ে ঠেকেছে। সামগ্রিকভাবে ১৯০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গোটা বিশ্বে জলস্তরের গড় বৃদ্ধি ছিল ০.২০ মিটার।
বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য মনুষ্যঘটিত কারণগুলোর ওপরই জোর দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের দাবি, ‘শহর এলাকাগুলোই উষ্ণায়নের মূল কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাগাতার তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে উষ্ণ বাতাস সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, যা শীতল হতে দীর্ঘ সময় লাগে। এই একই কারণে নদী, হ্রদ, জলাধার তো বটেই, গাছগাছালিতে ঘেরা সবুজ এলাকাগুলোতেও উষ্ণতা বহুক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে’।
এভাবে চললে, প্রতি ১০ বছরে একবার বা প্রতি ৫০ বছরে একবার যে তীব্র বন্যা কিংবা খরা হয়, আগামী দিনে তা আরও ঘন ঘন দেখা দেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা। যে সব জায়গায় এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সচরাচর চোখে পড়ে না, সেগুলিও বাদ যাবে না বলে জানিয়েছেন তারা।
এমনকি একই জায়গায়, একই সময়ে তাপপ্রবাহ এবং খরা একই সঙ্গে দেখা দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলে মত তাদের।
২০২১ সালের জুন মাস আমেরিকানদের জন্য রেকর্ড তাপদাহের মাস ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ১৩টি অঙ্গরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ৮০টির মতো দাবানল ছিল। ২০০০ সালের পর ১০টি বড় দাবানলের বছর ২০২১। এর কারণে যদি খরা হয়, খাদ্যপণ্যের দাম চলতি বছরই ৪০ শতাংশ বাড়বে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার সাক্ষী সারাবিশ্ব। জার্মানি বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। মারা গেছে অনেক মানুষ, আর্থিক ক্ষতি ৭০০ কোটি ডলার। চীনের বন্যা পরিস্থিতিও ভয়াবহ।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার সাক্ষী সারাবিশ্ব। জার্মানি বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। মারা গেছে অনেক মানুষ, আর্থিক ক্ষতি ৭০০ কোটি ডলার। চীনের বন্যা পরিস্থিতিও ভয়াবহ।
জলবায়ুর বর্তমান অবস্থা বলছে, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা আর ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে আর বেশি দেরি নেই। তাপদাহ মানেই পানি বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে, অনেক বেশি বৃষ্টি হচ্ছে, ঋতুর পরিবর্তনের কোনো ধারাবাহিকতা থাকছে না। ফলাফল কোনো স্থানে অতিরিক্ত বৃ্ষ্টিপাত, আবার কোনো স্থানে বৃষ্টিই হচ্ছে না’।
গবেষণা বলছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র, চীনের মতো বৃহত্তম অর্থনীতির দেশসহ অন্তত ৫৭টি দেশ অতিরিক্ত পানি সংকটে পড়বে। এর মধ্যে আছে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা আর মধ্য এশিয়াও। ২০৪০ সালে পানি স্বল্পতার ভয়াবহতা দেখবে এ দেশগুলো’।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় শীত মৌসুমে হালকা তুষারপাত হয়, বসন্তে হালকা বৃষ্টি। কিন্তু এ বছরের গ্রীষ্ম তো ক্যালিফোর্নিয়ার জন্য আগুনের মৌসুম এনে দিয়েছে। তাপদাহের কারণে খরা আর ভয়াবহ দাবনল দেখেছে ক্যালিফোর্নিয়া। মাটির নিচেও পর্যাপ্ত পানি নেই যা দিয়ে কৃষিকাজ করবেন এখানকার কৃষক। পানির জন্য অন্য অঙ্গরাজ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে ক্যালিফোর্নিয়া। গেল কয়েকবছরের দাবানলে নষ্ট হয়েছে অনেক কৃষিজমি।
বরফে ঘেরা পৃথিবীর মেরু অঞ্চল অ্যান্টার্কটিকায় সবচেয়ে দ্রুত বিশ্ব উষ্ণায়নের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। গেল ৫০ বছরে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে এখানকার তাপমাত্রা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই হারিকেন, বন্যা, দাবানলসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র’। দেশটির জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কোনো ধরনের প্রস্তুতি নেই উল্লেখ করে তারা আরও বলেন, ‘এখনই সময় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার। প্রস্তুতি না নেওয়া হলে ভবিষ্যতে পরিণতি আরও খারাপ হবে বলেও সতর্ক করেন তারা’।
বিজ্ঞানীদের দাবি, ‘জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাতাসের গুণমান এই দুটি বিষয় পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই বিশ্ব উষ্ণায়নকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে একসঙ্গে দুটির দিকেই নজর দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে ঘনবসতি, যত্রতত্র গগনচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণে রাশ টানতে হবে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট নির্মাণের সরঞ্জামের দিকে নজর দিতে হবে।
আরও বেশি করে সবুজ জঙ্গল, উদ্যান তৈরি করতে হবে। গার্হস্থ্য এবং শিল্পজনিত উষ্ণতাবৃদ্ধির কারণগুলোও খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে সব দেশের সরকারকে। জীবাশ্ম জ্বালানি, গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন কমিয়ে আনতে হবে। তাতে চলতি শতকের কিছুটা হলেও বিশ্ব উষ্ণায়নের রাশ টানা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তারা’।
পর্যবেক্ষকদের অভিমত, ‘বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের জন্য অতিশয় হুমকিস্বরূপ। এ বৃহৎ সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও পরাশক্তি দেশগুলোর আন্তরিকতা অনস্বীকার্য’।
তারা বলেন, ‘বিশ্বে জলবায়ুর ভয়াবহ বিপর্যয় সম্পর্কে সব দেশই অবগত হলেও কার্বন নিঃসরণ বা বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমার ক্ষেত্রে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শিল্পোন্নত দেশগুলো বরাবরই উদাসীন। সুতরাং আগামীর বিশ্বকে জলবায়ুর ভয়াবহ করালগ্রাস থেকে রক্ষা করার জন্য অতিমাত্রায় কার্বন ত্যাগকারী দেশগুলোকে বৃহত্তর স্বার্থে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার পথে হাঁটতে হবে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহযোগিতা নিশ্চিত করাই হবে সময়ের সেরা পদক্ষেপ’।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৫৩
আপনার মতামত জানানঃ