বাংলাদেশে ডেসটিনি, যুবকসহ বিভিন্ন মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসায় কাজ করে আসা একটি চক্র এখন নিউইয়র্কে সক্রিয় বলে জানা গেছে। বাংলাদেশে ডেসটিনি, ইউনিপে টু, এইম ওয়ে সহ বিভিন্ন ধরনের মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসায় জড়িত শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিরা নিউইয়র্কে ব্যবসার নামে প্রতারণার ফাঁদ ফেলেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতারণার জাল বিছিয়ে মানুষকে কোটি ডলার আয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছে তারা। তাদের প্রলোভনে পড়ে অনেকে বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। বড়লোক হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো নিজের জমা দেওয়া অর্থ খুইয়েছেন অনেকে।
জানা গেছে, দেশ থেকে সাধারণ মানুষের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করে বেশ কয়েকজন এমএলএম ব্যবসায়ী নিউইয়র্কে পাড়ি জমান। এখানে এসে নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বাড়ি কিনে তারা বসবাস শুরু করেন। বিশেষ করে নিউইয়র্কে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা জ্যাকসন হাইটস, জ্যামাইকা, ব্রুকলিনে ও ব্রঙ্কসে তাদের বসবাস।
এসব এমএলএম ব্যবসায়ীরা কমিউনিটির নিরীহ মানুষকে টার্গেট করে তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। পরে তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে অর্থ নেন। পরে মূলধনই আর ফেরত পান না এসব নিরীহ মানুষ।
চার/পাঁচ বছর ধরে একই লোকজন নানা নামে এমএলএম কোম্পানি খুলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছেন। মাঝে কয়েক মাস এই ব্যবসা ঝিমিয়ে থাকলেও এখন আবার এমএলএম ব্যবসা চাঙা হয়ে উঠেছে।
জানা গেছে, কমিউনিটি নেতা, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও আইনজীবীসহ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে এমন লোকদের টার্গেট করছে কোম্পানিগুলো। ব্যবসা শুরুর প্রথম কিছু দিন সব ঠিকঠাক চললেও কোম্পানির ‘ডান হাত বাম হাত ’ সার্কেলে যখন আর লোক বাড়ে না তখনই দেখা দিচ্ছে বিপত্তি। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলার দিলে প্রথম ব্যক্তি সেখান থেকে কমিশন পান। কোম্পানি থেকে ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয় তা সাধারণত ঘরে পড়ে থাকে। কমিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন হারবাল কিংবা ভেষজ ওষুধ বিক্রি করা হয়ে থাকে। এছাড়াও শারীরিক সুস্থতার জন্য কাজ করে অপ্রচলিত এমন চাইনিজ ইলেক্ট্রনিকসের যন্ত্রপাতিও এমএলএম পদ্ধতিতে বিক্রি করা হয়। বিদ্যুতের কপি সার্ভিসসহ নানা কিছুও রয়েছে।
টার্গেটকৃত এসব লোক তাদের পরিবারের সদস্য, আত্মীয় কিংবা নিকটস্থদের এ ব্যবসায় জড়িয়েছেন। প্রথম কিছু দিন ঠিকঠাক থাকলেও যারা পরের দিকে যোগ দিচ্ছেন তারা কোনো কমিশনই পাচ্ছেন না বা কিছু দিন পর নানা কারণে ঝরে পড়ছেন। এছাড়া শুরুর দিকে যারা যোগ দিচ্ছেন এবং সার্কেল আর না বাড়ায় তারাও আটকে আছেন একই স্থানে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে গোলযোগ। সৃষ্টি হচ্ছে পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা। মাঝখান দিয়ে একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। এ ক্ষেত্রে যার মাধ্যমে কোম্পানিতে যোগ দিচ্ছেন তিনি কিছু কমিশন পেলেও বাকিটা চলে যাচ্ছে কোম্পানির হাতে। মূলত এ মধ্যসত্ত্বভোগীদের কারণে কমিউনিটির অনেক মানুষ সর্বশান্ত হচ্ছেন।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমএলএম ব্যবসায়ী চক্র প্রথমে একজন সৎ মানুষ ও পরোপকারী হিসেবে নিজেকে মানুষের কাছে উপস্থাপন করেন। ব্যবসায় বেশি মুনাফার কথা বলে কোন একটি সেমিনারে আমন্ত্রণ জানান। সেমিনারের পরিচালক অত্যন্ত চতুর ও কৌশলী। গ্রাহকেরা ব্যবসা প্রসঙ্গে কী কী প্রশ্ন করতে পারেন, সে অনুযায়ী কৌশলী উত্তরও ঠিক করে রাখেন তিনি। সেমিনারে ব্যবসার লোভনীয় দিক উপস্থাপন করে তাদের নির্দিষ্ট ফরমে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। ফরমে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ইনফরমেশন ও সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর নিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। কোম্পানির সদস্য বানানো ও প্রোডাক্ট (ভিটামিন) দেওয়ার কথা বলে ৫০০ ডলার অথবা ১ হাজার ডলার নগদ অথবা ক্রেডিট কার্ডের তথ্য নিয়ে নেন।
আবার কেউ আত্মীয়তা অথবা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ব্যবহার করে অনেকটা জোর আবদার করে কোম্পানির সদস্য বানান। সদস্য হওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তার সম্পর্ক যাতে নষ্ট না হয়, সেই লজ্জায় ৫০০ অথবা এক হাজার ডলার দিয়ে অনেকে সদস্য হন। এভাবেই প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার ডলার নিয়ে যাচ্ছে এমএলএম ব্যবসায়ী চক্র।
এসব এমএলএম ব্যবসায়ীরা কমিউনিটির নিরীহ মানুষকে টার্গেট করে তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। পরে তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে অর্থ নেন। পরে মূলধনই আর ফেরত পান না এসব নিরীহ মানুষ।
ব্যবসার প্রথম ধাপে একজন গ্রাহক থেকে ৫০০ বা ১০০০ ডলার নেওয়ার পর তাকে ফুসলিয়ে আরও দুজন সদস্য বানানোর তাগাদা দেওয়া হয়। কারণ সে দুজন সদস্য বানাতে পারলে সেখান থেকে উভয় পক্ষই কমিশন পাবেন। ওই দুজন সদস্য আরও চারজন সদস্য বানাতে পারলে সেখানেও তাদের কমিশন থাকে। একই গ্রাহক কোম্পানি থেকে বেশি করে ভিটামিন কিনে বিক্রি করতে পারলে, সেখান থেকেও কমিশন পাবেন প্রথম ব্যক্তিসহ সবাই।
নিউইয়র্কে বাংলা ভাষার স্থানীয় পত্রিকা সাপ্তাহিক নবযুগ এর সম্পাদক শাহাব উদ্দিন সাগর জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, কিছু এমএলএম কোম্পানি তাদের চিরায়িত নিয়ম অনুয়ায়ী টার্গেটেড লোকদের উন্নত মানের হোটেল মোটেলে নিয়ে সভা সেমিনার করিয়ে এ ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। এছাড়া অনেকেই নিউইয়র্ক থেকে অন্য রাজ্যেও কাউকে কাউকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে নিয়ে তাদেরকে মগজ ধোলাই করা হচ্ছে। পরে তারা এসে কিছু দিন ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সামনের দিকে এগুতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েছেন। ফলে কোম্পানিগুলোতে যোগ দেয়ার সময় নানা কিছুর বিনিময়ে যে অর্থ দেয়া হয়েছিল সেগুলোর পুরোটাই গচ্ছা যাচ্ছে। এভাবে নিউইয়র্কে শত শত বাংলাদেশি খুইয়েছেন তাদের সঞ্চিত হাজার হাজার ডলার। এই ধরনের অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ফাঁদে প্রবাসী বাংলাদেশিরা
একটি এমএলএম কোম্পানিতে প্রতারণার শিকার হন জ্যামাইকার কামাল উদ্দিন। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে আমার কাছ থেকে এক হাজার ডলার নিয়ে সদস্য করা হয়। পরে আমি আমার পরিবারের ছয় সদস্যকে কোম্পানির সদস্য করি। ৩০০ ডলার কমিশনও পাই। সদস্যপদ গ্রহণ ও ভিটামিন কেনা বাবদ ১০ হাজার ডলার খরচ করি। কয়েক মাস ধরে আর কোন কমিশন পাই না। আমার পরিবার থেকে চাপে আছি, আমি যেন ডলার ফেরত নিয়ে আসি।’
জ্যাকসন হাইটসের আবদুল কাদের নামে আরেকজন বলেন, ‘দুই মাস আগে আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে আমি এমএলএম কোম্পানিতে যোগ দিই। আমি ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করে কোন ডলার ফেরত পাইনি। এরা প্রতারক। এদের থেকে সবার সাবধান হওয়া জরুরি।’
ব্রুকলিনের শাহ আলম বলেন, ‘আমার দুই হাজার ডলার খুইয়েছি। এখানকার এমএলএম কোম্পানির সঙ্গে জড়িতদের পদস্থ কর্মকর্তারা বাংলাদেশে যুবক–ডেসটিনিতে কাজ করা লোক। দেশে লোকজনের টাকা আত্মসাৎ করে এখানে এসেও একই প্রতারণা করছে।’
ব্রঙ্কসের বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আমি প্রতারিত হয়েছি। এই ব্যবসায় তিন হাজার ডলার লোকসান দিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, আমার আত্মীয় এসে বলেন, ‘মনে কর আমি তোমার ৫০০ ডলার খেয়ে ফেলেছি। আমার দিকে তাকিয়ে ৫০০ ডলার বিনিয়োগ কর।’ এভাবেই তিনি এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন বলে জানান।
ভুক্তভোগী চৌধুরী সাবের বলেন, প্রথমে প্রায় পৌনে ৩০০ ডলার দিয়ে কোম্পানিটিতে যোগ দিলেও পরবর্তীতে আমাকে প্রলোভন দেখানো হয় কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদের। আমার নিচের অনেক ডান হাত বাম হাতের টাকা দেওয়ার অনুরোধ জানালে আমি ধার করে প্রায় ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করি। কিন্তু যখন দেখতে পারি আমি ঠকে যাচ্ছি তখনই লোকসান দিয়ে বেরিয়ে আসি। অন্তত ৬ হাজার ডলার লোকসান হয়েছে।
ভুক্তভোগী ইসরাত জাহান বলেন, আমি দুই আত্মীয়কে নিয়ে যোগ দিয়েছিলাম। পরে তাদের একজনও কোন লোক দিতে না পারায় পরিবারের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়। পরে আমাদের পারিবারিক বিচ্ছেদ ঘটে।
শাহাব উদ্দিন সাগর নামে একজন বলেন, এমএলএম ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযোগের চেয়ে যারা এ ধরনের প্রলোভন দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি জরুরি। বিশ্বব্যাপী প্রচলন রয়েছে এমএলএম ব্যবসা কিন্তু নিউইয়র্কে কতিপয় মানুষের হাতে পড়ে এ ব্যবসার বারোটা বাজছে। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ কেউ যদি প্রলোভন দিয়ে নিয়ে যায় তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ