সড়কে ভাঙাচোরা থাকার কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ বেড়ে গেছে। খাদে পড়ে গাড়ি উল্টে যাওয়া কিংবা খাদ এড়াতে গিয়ে অন্য গাড়ির সাথে সংঘর্ষের মত ঘটনা প্রায় ঘটে চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনার একটি অন্যতম কারণ সড়কের অসঙ্গতি।
কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুর লবণ শিল্প এলাকা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে লবণ সরবরাহ প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। এই এলাকার একমাত্র চলাচল পথ ‘ইসলামপুর-বটতলী দেড় কিলোমিটারের সড়কটি’ খানাখন্দে মরণ ফাঁদে পরিণত হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এ রাস্তা দিয়ে যানবাহন চলাচল তো দূরে থাক পায়ে হাঁটাও দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। প্রায় সময় গর্তে পড়ে উল্টে খাদে পড়ছে লবণবোঝাই ট্রাক। গত দুই মাসে অন্তত ৫০টি লবণবোঝাই ট্রাক উল্টে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
লবণ বোঝাই ট্রাক উল্টে পড়ায় ক্ষতির মুখে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। লবণ পরিবহণে সরকারি রাজস্বের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে সড়ক উন্নয়ন ফি দেয়ার পরও যাতায়াত দুর্ভোগের কারণে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে মিল মালিক, লবণ ও পরিবহণ ব্যবসা সংশ্লিষ্টদের মাঝে।
এরপরও সংশ্লিষ্টদের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ফলে ভাঙা সড়কের কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যে কোনো সময় সারা দেশে লবণ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন লবণ ব্যবসায়ীরা। এতে সারা দেশে লবণ সংকটের আশঙ্কা রয়েছে।
সড়কটি দ্রুত সংস্কারের দাবিতে পথে নেমেছে এলাকাবাসী। ইসলামপুর সমাজ কল্যাণ ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে গতকাল শুক্রবার (২০ আগস্ট) ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন করেছে তারা। মানববন্ধনে স্থানীয় মিল মালিক, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতাসহ নানাপেশার লোকজন অংশ নেন।
নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা ট্রাক চালক আবুল বশর বলেন, পরিবহণের কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়া হয়। ইসলামপুরের মত অকেজো সড়ক কোথাও দেখিনি। বৃষ্টির পানি জমে থাকলে বুঝা যায় না কোথায় গর্ত আর সমতল। সরু হওয়ায় অন্য পাশ দিয়েও যাওয়া যায় না। এতে প্রতিদিন অনেক ট্রাক উল্টে দুর্ঘটনায় শিকার হয়। একই কথা বলেছেন, ট্রাকচালক, নুরুল আলম, আবদু রহমানসহ আরও অনেকেই।
ইসলামপুর লবণ মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনজুর আলম বলেন, লবণ পরিবহণের বিপরীতে ট্রাক প্রতি রাজস্ব দেয়া হয়। প্রতি বছর কোটি টাকা রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমলেও সেই অনুপাতে সড়কটির উন্নয়ন নেই। বিগত চার বছরেরও অধিক সময় খানাখন্দে ভরা সড়কটি। বছর দুয়েক আগে সড়কটি মেরামতে টেন্ডার হলেও ঠিকাদার কাজ সম্পন্ন করেনি। তবু থেমে নেই লবণ পরিবহন। মোটামুটি চলাচল নির্বিঘ্ন করতে বছর তিনেক আগে থেকে সড়ক উন্নয়ন ফি নামে প্রতি ট্রাক থেকে টাকা দেয়া হচ্ছে। এরপরও সড়কটির গর্ত ভরে না। বুধবার ও শুক্রবার লবণ বোঝাই দুটি ট্রাক সড়কের গর্তে উল্টে গিয়ে লাখ টাকার ক্ষতির মুখে পড়েন ব্যবসায়ী। দুর্ঘটনার কারণে গাড়ির লম্বা লাইন পড়ে যায়।
ইসলামপুর লবণ মিলমালিক সমিতির সভাপতি শামশুল ইসলাম আজাদ বলেন, কক্সবাজারই দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদনের জেলা। সারাবছর জেলায় যা লবণ উৎপাদন হয় তা পর্যায়ক্রমে ট্রলার ও ট্রাকযোগে ইসলামপুরে নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা। পরে লবণগুলো ইসলামপুরের ৭০টি লবণ মিল থেকে প্রক্রিয়াজাত করে ট্রাকযোগে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বাজারজাত করা হয়। দৈনিক ৮০ থেকে ১০টি লবণবোঝাই ট্রাক সারা দেশে লবণ সরবরাহ করে থাকে।
তিনি বলেন, এরপরেও গত চার বছর ধরে লবণ শিল্প এলাকার এক মাত্র সড়কটি গাড়ি চলাচলের অনুপোযোগী পড়লেও তা সংস্কারের গড়িমসি করা হচ্ছে। অথচ ট্রাকপ্রতি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।
একের পর এক লবণবোঝাই ট্রাক উল্টে খাদে পড়ে যাওয়ার ঘটনায় যে কোনো সময় সারা দেশে লবণ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে উল্লেখ করে মিল মালিক সমিতির সভাপতি শামশুল ইসলাম আজাদ জানান একটি ট্রাক উল্টে গেলে কমপক্ষে এক লাখ টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয় ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় ১৯৭২ সালে মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমান নামের এক উদ্যোক্তা ইসলামপুর লঞ্চ ঘাটে ‘কক্সবাজার সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ নামে লবণ মিল স্থাপন করেন। এর পর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে বাড়তে থাকে লবণ মিল। কালের পরিক্রমায় এখানে বর্তমানে প্রায় ৭০টি লবণ মিল রয়েছে। এখন নিয়মিত প্রক্রিয়াজাত কার্যক্রম চালাচ্ছে অর্ধশতাধিক মিল। কক্সবাজার জেলার অধিকাংশ লবণ এখানকার মিলে আনা হয়। আর দেশের চাহিদার ৯৫ শতাংশ লবণ কক্সবাজারেই উৎপাদন ও এখান থেকে সারা দেশে সরবরাহ হয়। বর্ষা মৌসুমেও এখান থেকে প্রতিদিন গড়ে ২০-৩০ ট্রাক লবণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। গ্রীষ্মে ট্রাকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০-৭০টিতে। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নাপিতখালী বটতলী এলাকা হয়ে ইসলামপুর লঞ্চঘাট পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার সড়ক দিয়েই লবণের এসব ট্রাক মহাসড়কে উঠে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়।
সূত্র আরও জানায়, বটতলী স্টেশন থেকে চৌফলদন্ডী ব্রিজ পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার সড়ক কার্পেটিং করতে প্রায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরে টেন্ডার হয়। মেসার্স চকরিয়া ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান এর কার্যাদেশ পায়। উন্নয়ন প্রকল্পের বেশ কয়েকটি কাজ শেষ হলেও ইসলামপুর বাজার থেকে নাপিতখালী পর্যন্ত কার্পেটিং হয়নি এখনও।
ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম বলেন, বটতলী স্টেশন থেকে ইসলামপুর বাজার সড়কটি শিল্পাঞ্চল হিসেবে ২৫ থেকে ৩০ মেট্রিকটন ওজনের যান চলাচল হয়। কিন্তু সড়কটি তৈরি হয় ১২-১৫ মেট্রিকটন ওজন বহনের উপযোগী হিসেবে। এতে সড়কটির জোড়াতালির সংস্কার কোনো কাজে আসছে না। চলাচল নির্বিঘ্ন করতে হলে এটি শিল্পাঞ্চল হিসেবেই সড়কটি গড়ন তৈরি করা জরুরি।
এলজিইডি কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুর রহমান জানান, সড়কটি আসলেই অতিগুরুত্বপূর্ণ। চলমান কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে তাগাদা দেয়া হচ্ছে।
সড়কটি কাজের সার্বিক বিষয়ে জানতে মেসার্স চকরিয়া ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির মালিক ফরিদুল আলমের মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার কল করা হয়। কিন্তু তিনি কল রিসিভ করেননি।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১২৫৬
আপনার মতামত জানানঃ