‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা’ বাংলা প্রবাদটির কথা কে না জানে? গল্পের ঘোঘের ভয় দেখিয়ে এককালে শিশুদের ঘুমও পাড়াতেন মায়েরা। গল্প মনে হলেও প্রাচীন পৃথিবীতে ঘোগ নামের প্রাণীরা সত্যি সত্যিই ছিলো। তবে বাংলা প্রবাদ বাক্যটির জন্মস্থল বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গে নয়, এমনকি অখণ্ড ভারতবর্ষেও নয়, বাঘ ও কুকুরের মাঝামাঝি বন্য প্রাণীটির আবাসস্থল ছিলো সুদূর অস্ট্রেলিয়ায়। আর সেদেশে এর নাম ছিলো থাইলাসিন।
১৯৩০ সালের আগেও অস্ট্রেলিয়া, তাসমানিয়া আর পাপুয়া নিউ গিনির বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে ঘুরে বেড়াত থাইলাসিন। তার মুখ আর দেহটা দেখতে কুকরের মতো। পিঠে বাঘের মতো কালো ডোরাকাটা দাগ। আর লেজটা ক্যাঙ্গারুর লেজের মতো, যেন তিনটি প্রাণী মিলে বিশেষ এক জাতের প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছে।
গল্পে যেভাবে ‘হিংস্র প্রাণী’ বলা হয়, থাইলাসিন কিন্তু মোটেও তেমন নয়। বরং খুবই নিরীহ প্রাণী ছিলো এরা। বুনো কুকুর জাতীয় ‘বাঘের শত্রু’ বলে চিহ্নিত এই প্রাণীটি ‘তাসমানিয়ান বাঘ’ নামেও পরিচিত ছিলো। কারণ, অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়া দ্বীপে বসবাস করতো এরা।
দশ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই ঘোগ। তবে নেকড়ে শাবকের মতো দেখতে ঘোগ সদৃশ আধুনিক থাইলাসিন বিংশ শতাব্দীতেও বেঁচে ছিলো তাসমানিয়া দ্বীপে।
প্রাণীজগতে শক্তিশালী প্রাণী বলেও পরিচিত ছিলো না থাইলাসিন। সর্বোচ্চ ক্যাঙ্গারু ও ক্যাঙ্গারু সদৃশ আরও ছোট প্রাণী ওয়ালাবাইস শিকার করতে সক্ষম ছিলো তারা। আর এ শিকারির বদনামই তাদের চূড়ান্ত পতন ডেকে আনে। তাসমানিয়ার ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসকরা তাদের শিকারি চেহারা থেকে অনুমাণ করে বসেন যে, এরা তাদের ভেড়ার ওপর আক্রমণের জন্য দায়ী ছিলো।
একটা সময় পর্যন্ত সুখে দিন কাটলেও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ১৮০০ সালের দিকে প্রাণীটির উপর নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। মানুষ আর প্রকৃতির নির্মমতায় একের পর এক মারা পড়তে থাকে প্রাণীটি। একসময় যে প্রাণীর সংখ্যা ছিল অগণিত, ১৯০০ সালের দিকে এসেই সেই প্রাণীর সংখ্যা হয়ে যায় হাতে গোণার মতো। ধারণা করা হয়, ইউরোপের তাসমানিয়াতেই কমপক্ষে ৫ হাজার থাইলাসিনের বসবাস ছিল। কিন্তু শিকারে পরিণত হওয়া, বাসস্থান ধ্বংস আর রোগব্যাধির কারণে প্রাণীটি খুব দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১৯৩০ সালে মানুষের জানা সর্বশেষ বন্য থাইলাসিনটি এক শিকারির গুলিতে নিহত হয়। এরপর আর কোনো দিন বন্য থাইলাসিনের দেখা মেলেনি। ১৯৩৬ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকার প্রাণীটি সংরক্ষিত ঘোষণা করে। কিন্তু ততদিনে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। বন্য থাইলাসিন তো আগেই শেষ, চিড়িয়াখানায় রাখা সর্বশেষ থাইলাসিনটিও মারা যায় একে ‘সংরক্ষিত প্রাণী’ ঘোষণার ৫৯ দিন পর।
১৯৩৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, অস্ট্রেলিয়ার হোবার্টের বোম্যারিস চিড়িয়াখানায় বেঞ্জামিন নামের সর্বশেষ থাইলাসিনটি মারা যায়। এরপর ১৯৮৬ সালে প্রাণীটিকে সরকারিভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
যদিও অসমর্থিত সাইটে এখনও এটিকে দেখা যায় বলে দাবি করা হয়েছে। তবে তাসমানিয়ার এখনকার ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং তাত্ত্বিকভাবেও দ্বীপটি এমন প্রাণীদের বসবাসের উপযুক্ত নয়। এটিকে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে প্রশ্ন এসে যায়, থাইলাসিনরা কি ছাই থেকে উঠবে?
থাইলাসিনরা মানবতা ধ্বংস করার ক্ষমতা সম্পন্ন প্রজাতি বলেও সন্দেহ করা হয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। স্বজাতির ঘরে ঢুকে কেউ তার ক্ষতি সাধন করতে চাইলে তাকেই বাঘের ঘরে বাসা বাধা ঘোগ বলে সম্বোধন করা হতো। এ থেকেই তৈরি হওয়া প্রবাদবাক্য বা কাহিনীগুলো তাই কারও জন্য একটি সতর্কতা হিসেবেও কাজ করে।
তবে এ বাংলায় না পাওয়া যাওয়া এবং সুদূর অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়া দ্বীপে বসবাস করা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীটি কীভাবে বাংলায় ঢুকে পড়লো— সে রহস্য রয়ে গেছে আজও।
ছবি: https://rarehistoricalphotos.com/
এসডব্লিউ/কেএইচ/২০০০
আপনার মতামত জানানঃ